আপনার মতে আগামী ১০ বছরে দুনিয়ায় কী কী পরিবর্তন ঘটবে?
পৃথিবীর জন্য ছাড়ুন, নিজের জন্য দশ বছরের ভবিষ্যদ্বাণী করতে গেলেই দেখি সাহস আর আত্মবিশ্বাসেরা গুটি গুটি পায়ে লুকিয়েছে পর্দার আড়ালে। বিশ্বাসে, বিশ্বাসভঙ্গে, ব্যবহারে, পছন্দ অপছন্দে, অর্থনৈতিকভাবে, দৈহিক আর মানসিকভাবে আমি সামনের দশ বছরে কোন মানুষ হয়ে উঠব? দশ বছর আগের আমির সাথে আজকের আমির মিল খুঁজতে বসেই দেখি কাটাকুটি করে হাতে থাকছে ভগ্নাংশ। তবে সামনের দশ বছরে?
যে দ্রুততায় নিজেকে সহ চারপাশ বদলে যাচ্ছে তা দেখলে একইসাথে উত্তেজনা আর ভয় জাগে। এবং চিন্তার বিষয় হল ‘বদল’টা ভালো না খারাপের অক্ষে হতে চলেছে তাও আগে থেকে বোঝার কোনও উপায় থাকে না আমাদের জন্য।
যে প্লাস্টিক আবিষ্কার করে উঠে মানুষের একসময় মনে হয়েছিল ‘আপুন হি ভগওয়ান হ্যায়’ এখন তাইই তার কাছে ফিরে এসেছে জ্বলন্ত ব্যুমেরাং হয়ে। এই সেদিন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর হাত ধরে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম ঘাতক ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধে, আর আজ যথেচ্ছ ব্যবহারে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিকেরা অকেজো হয়ে যাচ্ছে জীবাণুদের বিরুদ্ধে। যে সোশ্যাল মিডিয়াকে এই সেদিনও মনে হয়েছিল আশীর্বাদ, আজ নিজেদের দিকে তাকালেই দেখতে পাই তা এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।
সময়টা যেহেতু দশবছর তাই সাহসে ভর করে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করাই যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার যেহেতু ভবিষ্যৎ চর্চা নিয়ে বেশ আগ্রহ আছে তাই সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হব মেনে নিয়েও উৎসাহটা একটু বেশিই। এর মধ্যে বেশকিছু ভবিষ্যদ্বাণী পৃথিবীর বিভিন্ন নামীদামী বৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানীগুণী মানুষের আলোচনায় প্রায়শই উঠে আসা— অর্থাৎ এদের নিয়ে প্রায় নিশ্চিত থাকতে পারা যায় যে এরা ঘটবেই, সময়টা দু’ পাঁচ বছর এদিক ওদিক হলেও হতে পারে। আর কিছু একেবারেই আমার নিজস্ব মনে হওয়া— বর্তমানকেই একটু টেনে নিয়ে গিয়ে ভবিষ্যতে অভিক্ষেপ।
কম্পিউটার দীর্ঘ সময়ের জন্য ট্যুরিং টেস্ট পাশ করবে। এককথায় বললে, চিন্তাভাবনা বা বুদ্ধিমত্তা যে কোনও দিক থেকেই একটি কম্পিউটার একজন মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। বলে রাখা ভালো এটা শুধু প্রযুক্তিবিদ্যা নয়, গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাসের জন্য একটা দিকচিহ্ন হয়ে থাকার মতো ঘটনা হবে। রে কুর্জওয়েলের মতে সালটা ২০২৯।
এই সময়ের আশেপাশেই মঙ্গলে প্রথম মানুষ যাবে। এবং কোম্পানিটা যেহেতু স্পেস এক্স আর মানুষটা যেহেতু এলন মাস্ক, খুব অসুবিধে না হলে এই ভবিষ্যদ্বাণীটি মিলে যাওয়ার ব্যাপারে আমি যথেষ্ট আশাবাদী।
ব্যাপ্তিতে ১৯২৯ এবং ২০০৮ এর মতোই বিশ্ববাজারে আরেকটি ভয়ঙ্কর ধ্বস নামবে। এর আগে এবং পরে মিলিয়ে বেশ কিছু ছোট এবং দুর্বল অর্থনীতির দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে।
এবং বাজার অর্থনীতি ও মানব চরিত্রের সূত্র মেনেই এর পাশাপাশি ঘনিয়ে আসবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেঘ। তবে এ নিয়ে খুব নিশ্চিতভাবে বলার মতো জায়গায় কেউই পৌঁছতে পারেন নি। অনেকের মতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তীতে পরমাণু বোমায় গোটা মানব সভ্যতার ধ্বংস শুধু সময়ের অপেক্ষা, আবার অনেকের মতে যাইই হয়ে যাক না কেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক চ্যাপ্টারটি কখনই লেখা হবে না। যত দিন যাবে মানুষ সবমিলিয়ে আরও শান্তিপ্রিয় হয়ে উঠবে, একসাথে পাশাপাশি বাঁচতে শিখবে। বলে রাখি, এই শুভবুদ্ধি এবং শান্তিতত্ত্বের ওপর ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস বা ভরসা নেই।
জৈবপ্রযুক্তিতে (Biotechnology) আমরা এতটাই এগিয়ে যাবো যে নিজেদেরই আর চিনতে পারব না। অন্তত সংজ্ঞার দিক থেকেই মানুষকে আর চিনতে পারা যাবে না। বিবর্তনকে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা নিজেদের শরীরকে আরও দৃঢ়, টেকসই এবং দীর্ঘকালীন করতে শিখব।
জৈবপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি এবং সবমিলিয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাবে। উন্নত তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রেও সামনের দশ- পনেরো বছরে গড় আয়ু প্রায় দশ বছর বেড়ে যাবে।
পাল্লা দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়বে। সামাজিকভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে সুবিধেভোগীরা আরও বেশি বেশি সুবিধে কুক্ষিগত করবে, ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতা। দুর্বল এবং অক্ষমেরা তলিয়ে যাবে আরও আরও অন্ধকারে। গরীব আরও গরীব হবে, ধনী হবে ধনকুবের।
মানুষ গড়পড়তা আরও অলস এবং বোকা হবে। যন্ত্র এবং প্রযুক্তির কারণেই যত দিন যাবে দৈহিক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা ততই কমে যাবে, এবং পাল্লা দিয়ে গভীরভাবে ভাবার ক্ষমতা, জটিল সমস্যার সমাধান করার দরকারও হু হু কমে যাবে।
জল স্থল অন্তরীক্ষ জুড়ে তাদের প্লাস্টিক বর্জ্য আর বিষধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া চলতেই থাকবে। ধ্বংস হবে প্রকৃতি, বিলুপ্ত হয়ে যাবে একের পর এক জীব, একের পর এক মেট্রোশহর পরিণত হবে গ্যাসচেম্বারে।
অবসাদ এবং অন্যান্য মানসিক রোগ মহামারীর আকার নেবে। সমাজ এবং পৃথিবী এত দ্রুত বদলে যাবে যে বেশিরভাগ মানুষ তাকে বুঝতেই পারবে না, খুঁজে পাবে না নিজেকে। একলামি, অর্থহীনতা, প্রত্যাশা আর তার চাপ, হীনম্মন্যতা, অবসাদ চেপে বসবে বুকের ওপর।
সন্তান উৎপাদন বা পরিবার তৈরির জন্য বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে সম্পর্কিত হওয়া কমে যাবে। এর ফলে পরিবার এবং সমাজের মূল গঠনটাই ভেঙে যেতে পারে।
ভবিষ্যতের কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা থাকে না। ভালো আর খারাপ, দুশ্চিন্তা আর উদ্দীপনা মিলিয়েই সে অবস্থান করে বর্তমানের গর্ভে। তাকে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব শেষপর্যন্ত আমাদেরই।
ধন্যবাদ
মাইকেল হালদার
Thanks