ইসলামের উত্থান ও পতন
মধ্যযুগের ইতিহাস হচ্ছে মানব সভ্যতার এক অন্ধকার অধ্যায় – এই আক্ষেপ সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের প্রায় সবাই করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই রূঢ় উক্তি আংশিক সত্য। কারন, এই অন্ধকার যুগ শুধু ইউরোপের ইতিহাস, সমস্ত মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ নয়। মধ্যযুগে ইউরোপ যখন দর্শন ও মুক্তিবুদ্ধির চর্চা নিষিদ্ধ করে, ধর্মীয় চাদরে সারা শরীর ঢেকে কল্পিত ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে ব্যস্ত ছিল; ঠিক সেই সময়ে মুসলিম বিশ্ব এগিয়ে এসেছিলো বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায়। সেসময়ে মুসলিম জগতই হয়ে উঠেছিল সারা পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত অংশ।
এটা ঠিক যে সেইসময় মুসলিম বিশ্বের এই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চা নিরংকুশ বা প্রতিবন্ধকতাহীন ছিল না। তবুও প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই মুসলিম বিশ্ব তাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো, যা তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজ পারেনি। তাই জর্জ সার্তন তার বিখ্যাত “বিজ্ঞানের ইতিহাস” বইয়ে মন্তব্য করেছেনঃ
“অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে একাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মানবজাতির সবচেয়ে প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক ভাষা ছিল আরবি। মুসলিম বিশ্বে সে যুগে জন্ম নেয়া অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, যাদের সমমানের কাউকে পশ্চিমী বিশ্বে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল; তাদের কয়েকজন হচ্ছে জাবির ইবনে হায়ান, আল কিন্দি, আল খাওয়ারিজমী, আল ফার্গানি, আল রাজি, আল ফারাবী, আল মাসুদ, আল তাবারী, আবুল কাসেম, আল বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইসাম, আল জারকিলি, ওমর খৈয়াম। যদি কেউ দাবি করে যে, মধ্য যুগ ছিল বিজ্ঞান ক্ষেত্রে বন্ধ্যা, তাদের অসংখ্য নাম হতে শুধুমাত্র এই কয়েকটি নাম শুনিয়ে দাও, যারা ৭৫০ হতে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ – এই তুলনামূলক স্বল্পসময়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।”
সমসাময়িক বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞান সাময়িকী “নেচার” তার একটি সংখ্যায় মন্তব্য করেছে “মুসলিম বিশ্ব তার স্বর্ণযুগে, প্রায় হাজার বছর পূর্বে বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে – বিশেষত গণিত ও চিকিৎসা বিদ্যায়। তার সমৃদ্ধির সময়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ছুটে যেত বাগদাদ ও মুসলিম স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তৎকালীন মুসলিম শাসকেরা দরবারে পরিবেষ্টিত থাকতেন নামকরা বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিল্পীদের দ্বারা। মুক্তচিন্তার এক উদার আবহাওয়া সম্ভব করেছিল ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম মনীষীদের একই সাথে কাজ করতে।”
কিন্তু আজ তা শুধু স্মৃতি মাত্র।
কল্পনা করা যাক যে, খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে কোন ভিন্নগ্রহের আগন্তক পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছেন পার্থিব সভ্যতার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে। তারা তাদের ভ্রমণ শেষে নিজগ্রহে ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করতেন, তার সারমর্ম হতো যে, তৎকালীন বিশ্বের মুসলিম অংশটি হচ্ছে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার অধিকারী, প্রগতিশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল। বাগদাদ ও মুসলিম স্পেনের মানমন্দির, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, পাঠাগার ইত্যাদি হচ্ছে সে সময়ে সবচেয়ে আধুনিক। তাদের কাছে মনে হতো যে ইবনে হাইসাম কিংবা ওমর খৈয়ামের মতো মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতেই রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ। পক্ষান্তরে এই সময় ইউরোপ হচ্ছে অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, যা ব্যস্ত রয়েছে ডাইনি ও ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে বের করে জ্যান্ত পোড়াতে।
মনে করা যাক সেই একই গ্রহ থেকে আর একটি আগন্তক দল এসেছেন বর্তমান পৃথিবীতে বেড়াতে। তারা এবারে কী দেখবেন? তাদের আগের প্রতিবেদনকে মিথ্যা প্রমান করে দেখা যাবে যে, প্রতিশ্রুতিশীল মুসলিম বিশ্ব ডুবে গেছে কুসংস্কার ও পশ্চাদ্পদতায়। পক্ষান্তরে যে অংশটি তখন ছিল অন্ধকারচ্ছন্ন, তারা আজ সারা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে মহাকাশে। বিস্মিত হয়ে তারা তখন ভাবতেন, এটা কী জন্য হলো? এটাই কি মানব সভ্যতার উত্থান-পতনের অমোঘ নিয়তি, নাকি তা উল্লেখিত দুটি অংশের সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের জন্য ঘটেছে?
মুসলিম স্বর্ণযুগে তাদের এই গৌরবময় উত্থান কেন ঘটেছিলো, এর উত্তরে গোঁড়া ধর্মতাত্ত্বিকেরা মনে করেন – মুসলিম জনগোষ্ঠী তার প্রাথমিক যুগে ছিল খুব ধর্মভীরু, যার ফলে তারা আধ্যাত্মিক ও ঐশী জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে পেরেছিলেন, যা ছিল ধর্মভীরু মুসলমানদের জন্য এক ঐশী পুরস্কার। কিন্তু যখনই তারা পরবর্তীকালে ধর্মীয় পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে ক্রমশ ধর্মহীনতার দিকে সরে আসছিলেন, তারা বঞ্চিত হয়েছে আল্লাহরর করুনা থেকে। আর তাই তখন ধর্মতাত্ত্বিকেরা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আহবান করেন, তারা যেন ধর্মনির্দেশিত পথে আবার ফিরে যান এবং আল্লাহর অনুগ্রহ পুনরায় লাভ করেন। তাদের কাছে কোরান ও হাদিসই ছিল প্রকৃত জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎস।
কিন্তু তাদের এই যুক্তির বিপরীতে সংশয়বাদীদের একটি দাবি লক্ষণীয় যে মুসলিম স্বর্ণযুগ কিন্তু তুলনামূলকভাবে উদার খলিফাদের শাসনামলেই ঘটেছিলো, যখন মুক্তিবুদ্ধির চর্চা ও ভিন্নমতকে সহনশীল দৃষ্টিতে দেখা হতো। উদার নৈতিকতায় বিশ্বাসী আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর, হারুন আল রশিদ, আল মামুন কিংবা উমাইয়া স্পেনিশ শাসক খলিফা ৩য় আব্দুর রহমান, ২য় আল হাকাম – এদের দরবারেই সবচেয়ে বরেণ্য বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের উন্মেষ ঘটেছিলো। তার বিপরীতে গোড়াপন্থী ধর্মানুরাগী খলিফা মুতাওয়াক্কিল, আল হাদি, খাওয়ারিজম শাহ প্রমুখের শাসনামলে নয়।
জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের বর্তমান পতনকে আবার অনেক গোঁড়া ধর্মান্ধ সাপে বর হিসাবে মনে করেন। কেননা এর ফলে মুসলিম সমাজ মুক্ত থাকতে সক্ষম হয়েছে সংশয় ও অবিশ্বাসের হাত থেকে। তাদের মতে দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা থেকে অবধারিতভাবে জন্ম নেয় ধর্মহীনতা, যা সনাতন ধর্ম বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে যুক্তি ও বুদ্ধির প্রাধিকারকে সমর্থন করে। আর তাই তাদের মতে মুসলমানদের জন্য সে পথ অবশ্য পরিত্যাজ্য।
ইসলাম ধর্মপ্রণেতা ও আরব জাতির অবিসংবাদিত নেতা হজরত মুহাম্মদ পরলোক গমন করেন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যুর পরই প্রকৃতপক্ষে আরব জাতির বহির্বিশ্ব অভিযান শুরু হয় এবং তা এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলে. ৬৩৪ সনে সিরিয়া আক্রান্ত হয়ে দুইবছরের মধ্যে তা বিজিত হয়, ৬৩৭ সনে পারস্য আক্রান্ত হয় এবং ৬৫০ সনে তা সম্পূর্ণ অধিকৃত হয়. ৬৬৪ সনে আক্রান্ত হয় ভারতের সিন্ধু, ৬৬৯ সনে কনস্টান্টিনোপল – যদিও তা তাৎক্ষণিকভাবে বিজিত হয়নি। মিসর অধিকৃত হয় ৬৪২ সনে , কার্থেজে ৬৯৭ সনে। এর কিছুকাল পর ৭১১-৭১২ সনে জিব্রাল্টার পেরিয়ে মুসলমানরা পৌঁছে যায় স্পেনে। পশ্চিম ইউরোপের এক বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলমানদের অধিকারে এলেও ৭৩২ সনে আল্পস পর্বতমালা সন্নিকটে টুরস এর যুদ্ধে খ্রিস্টান শক্তির হাতে তাদের পরাজয় ইতি টানে ইউরোপে মুসলিম সম্রাজ্যের আরো অধিক সম্প্রসারণে। আর সে ঘটনা হজরত মুহাম্মদের মৃত্যুর ঠিক একশো বছর পর।
আরব জাতি তাদের ধর্মপরায়ণ স্বভাবের জন্য কখনো বহির্বিশ্বে সুপরিচিত ছিল না। যে শক্তি তাকে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে বন্ধ্যা আরবভূমি থেকে বাইরে নিয়ে এসেছে তা ধর্ম নয়, বরং বহির্বিশ্বের অফুরন্ত সম্পদের হাতছানি। বহু প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী পারস্যবাসীরা সে তুলনায় বরং অনেক সুসভ্য – দার্শনিক ও ধর্মীয় চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল। আর তাই তুলনামূলকভাবে হীন সভ্যতার অধিকারী আরবজাতির তলোয়ারের কাছে তাদের নতিস্বীকার করতে হলেও তারা তাদের পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সম্ভবত এ কারণেই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে শিয়া মতবাদ গ্রহণে, যা আরবজাতির মূল সুন্নী – মুসলিম সংস্কৃতি হতে তাকে কিছুটা হলেও পৃথক সত্তা দান করেছে। আরো একটা কারণ হচ্ছে ইসলাম ধর্মের রোমান্টিকতা বর্জিত সহজ-সরল একেশ্বরবাদ প্রাচ্যের রহস্যবাদী মিস্টিক সাধু-সন্তদের জন্মভূমি ইরানে ততটা শিকড় গাড়তে পারেনি। যাহোক, মূলত পারস্য প্রভাবেই বাগদাদ-ভিত্তিক আব্বাসীয় খলিফারা প্রথম মুসলিম খেলাফত দামেস্ক-ভিত্তিক উমাইয়াদের পরাজিত করেন। এর ফলে বাগদাদ হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম সভ্যতার একচ্ছত্র কেন্দ্র, যা তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল ছিল ১২৫৬ সনে মোঙ্গলদের অশ্বক্ষুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন না হওয়া পর্যন্ত। অন্যদিকে বিজিত উমাইয়া বংশের এক যুবরাজ আব্দুর রহমান কর্তৃক স্পেনে স্থাপিত হয় এক গৌরবময় মুসলিম সাম্রাজ্য; যা বাকি আরবজগৎ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবেই কয়েক শতাব্দী টিকে থাকে।
মুসলিম ইতিহাসকে কমপক্ষে ৪টি ভাগে ভাগ করা যায় – প্রাথমিক স্থাপনার যুগ উমাইয়া শাসনকাল (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত), ধ্রুপদী আব্বাসীয় যুগ (৭৫০ – ১০০০ সাল ), প্রান্তিক আব্বাসীয় যুগ (১০০০ – ১২৫০ সন ) এবং ক্ষয়িষ্ণু মধ্যযুগ (১২৫০ – ১৫০০ সাল পর্যন্ত)। প্রাথমিক যুগের উমাইয়া শাসনকালে মুসলিম শাসকেরা ব্যস্ত ছিলেন রাজ্যজয় ও শাসন সুসংহত করার কাজেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে দর্শন বিজ্ঞান চর্চায় তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় নি – অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। মূলত ধ্রুপদী আব্বাসীয় আমলেই মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। ইসলাম ধর্মের এই যৌবনকালে তা ছিল প্রাণবন্ত ও গতিশীল; যেমন তা রাজনৈতিক ভুখন্ডগতভাবে, তেমনি আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও দ্রুত সম্প্রসারণশীল। সাম্রাজ্য বিস্তার ও বাণিজ্যের ফলে আহরিত ধন সম্পদ এক সমৃদ্ধ শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, যারা ইতিমধ্যে বহির্বিশ্বের জ্ঞানজগতের সংস্পর্শে এসেছে। তারা আর তাদের পূর্বপুরুষ যাযাবর আরবদের মতো শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত নয়, তারা নিজেদের ভেতর অনুভব করে আরো বেশি কিছু করার তাগিদ। এভাবেই তাঁদের মধ্যে জন্ম নেয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার আকাঙ্খা। তার মাধ্যমে শুরু হয় মুসলিম জাগরণের স্বর্ণযুগ।
প্রাথমিকভাবে এই চর্চা শুরু হয় গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানসমূহ – প্রকৃতিবিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ের উপর লিখিত পুস্তকসমূহ অনুবাদে। তাদের জ্ঞানকে আরবরা বলতো প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞান (ইলমুল আওয়াল)। আর ইসলাম পরবর্তীযুগের জ্ঞানকে বলা হতো ইলমুল আখের। প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞান আরবিতে অনুবাদের কাজ প্রথমে শুরু হয় ইরানের বিভিন্ন শহর – জুনিশাপুর, সিরাজ, নিশাপুর ইত্যাদিতে। তবে পরবর্তীকালে বাগদাদই হয়ে দাঁড়ায় এর মূলকেন্দ্র। অনুবাদকারীদের বেশিরভাগই তখন ছিলেন অমুসলমান – খ্রিষ্টান, ইহুদী, হিন্দু ইত্যাদি। নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান হুনায়ন ইবনে ইসহাক গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন ও গণিতের পুস্তকসমূহ আরবিতে অনুবাদ করেন। সাবিয়ান খ্রিস্টান খতিব ইবনে কুবরাহ জ্যোতির্বিদ্যা ও পিথাগোরাসের দর্শন, জ্যাকোবাইট আবু বিশার মাখা ও ইয়াহিয়া বিন আদি, ভারতীয় বৌদ্ধ ভিখ্খু বার্মিক বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তাদের নিজস্ব ধর্মপালনের স্বাধীনতায় কখনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। খলিফা আল মনসুরের দরবারে অনুবাদক ইবনে জিব্রিলকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন না, তখন তিনি নির্ভয়ে উত্তর দিয়েছিলেন – “আমার পূর্বপুরুষেরা স্বর্গ বা নরক যেখানেই থেকে থাকুক না কেন, আমি তাদের সাথেই মিলিত হতে চাই।” খলিফা তখন তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হন। এই যুগের অর্জন প্রধানত বিদেশী সভ্যতার জ্ঞানকে নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ ও সংহত করতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সম্ভব হয় উদারমনা শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ধ্রুপদী আব্বাসীয় যুগের শেষদিকেই এই অনুবাদ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং ইসলামী সভ্যতা এক নতুন স্তরে প্রবেশ করে। এর মধ্যেই গ্রিক ভাষাকে সরিয়ে আরবি ভাষাই হয়ে দাঁড়ায় আরব জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বাহন। প্রাথমিক যুগের বিপরীতে এ যুগের মনীষীরা সবাই হচ্ছেন মুসলমান। এ যুগেই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মুসলিম মনীষীরা জন্ম নিয়েছেন এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন – যেমন আল ফারাবী (৮৭০-৯৫০), ইবনে হাইছাম (৯৬৫-১০৩৯), ফেরদৌসী (৯৪০-১০২০), আল বিরুনী (৯৭৩-১০৫১), ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭), ওমর খৈয়াম (১০৩৮-১১২৩), নাসিরুতুসি (১২০১-১২৭৪) প্রমুখ।
মুসলিম যুগে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও তাকে ছাড়িয়ে গেছে আলকেমি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, জ্যামিতি ও ভূগোলবিদ্যায় তাদের অর্জন। চিকিৎসাবিদ্যায় মুসলমানরা প্রথম উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে চোখখু রোগের চিকিৎসায়, কেননা বাগদাদের ধূলিধূসর আবহাওয়ায় চোখখুরোগের প্রকোপ ছিল খুব বেশী। চোখখুরোগ সম্পর্কিত সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থটি রচনা করেন ইবনে মাসাওয়া (৭৭৭-৮৫৭)। ভেষজ বিদ্যার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, ভেষজ বিদ্যার প্রথম স্কুল ও প্রথম ফার্মাকোপিয়া এ সময়ের আরবদেরই অবদান। খলিফা মামুন ও মুতাসিমের শাসনামলে ফার্মাসিস্টদের পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে শুধু যোগ্যরাই এ পেশায় জড়িত থাকতে পারেন। নবম শতকের প্রথম দিকে বাগদাদে উৎকৃষ্ট মানের হাসপাতাল স্থাপিত হয় খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনামলে। পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় হাসপাতাল, এমনকি ভ্রাম্যমান ক্লিনিকও। মুসলিম যুগের সবচেয়ে নামকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের প্রায় সবাই পারস্য বংশোদ্ভূত আরবি ভাষী – যেমন আলী আল তাবারী, ইবনে জাকারিয়া আল রাজি, আল মাজুসী, আলী ইবনে আব্বাস, আবু আলী ইবনে সিনা প্রমুখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুস্তক প্রণেতা হলেন আল রাজি (৮৬৫-৯২৫), যার ১১৩টি মুখ্য ও ২৮টি গৌণ পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়। ইউরোপের অনেক ভাষাতেই তার রচনাবলী প্রকাশিত হয়ে পরবর্তী সাত-আটটি শতাব্দী ধরে তা পঠিত হয়েছিল। রাজির পরে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম ইবনে সিনার (৯৮০-১০৩৭), যদিও দর্শন ক্ষেত্রে তার অবদান চিকিত্সাবিদ্যার চেয়ে কম নয়। তার এক আধুনিক জীবনীকার সিনার রচিত কমপক্ষে ২০০টি পুস্তকের কথা উল্লেখ করেছেন – দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি মিলিয়ে। তার সবচেয়ে মূল্যবান পুস্তক “আল কানুন ফি আল তিব্ব” এর বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত সমস্ত ইউরোপে চিকিৎসাবিদ্যায় মূল পাঠ্যপুস্তক ছিল। ডাঃ অসলারের মতে “আল কানুন” হচ্ছে অন্য যে কোনো বইয়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে পঠিত এক মেডিকেল বাইবেল।
মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু হয় মূলত ভারতীয় প্রভাবে। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার বিখ্যাত পুস্তক “সিদ্ধান্ত” বাগদাদে আসে ৭১১ সনে এবং তা মোহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম কর্তৃক আরবিতে অনূদিত হয়। এই পুস্তকটিই প্রথম দিকের মুসলিম জ্যোতির্বিদদের কাছে আদর্শও হিসেবে গণ্য হতো. গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমির বিশাল পুস্তক “আলমাজেস্ট” আরবিতে অনূদিত হয় নবম শতকের প্রথম দিকে। খলিফা আল মামুনের সময়কালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত মানমন্দির “বায়তুল হিকমা” যার মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যার তথ্যসমূহ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষন ও পরিমাপ করা হতো. খলিফা মামুন পরবর্তীকালে দামেস্কেও একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আল মামুনের জ্যোতির্বিদরা ফোরাত নদীর তীরবর্তী সমতল ভূমিতে দ্রাঘিমারেখার দূরত্ব পরিমাপ করে বের করে ৫৬.৬৬ মাইল – যাতে প্রকৃত দূরত্বের সাথে পার্থক্য মাত্র ২৮৭৭ ফুট। আরবদের প্রণীত জ্যোতির্বিদ্যার সারণি তাদের বিশুদ্ধতার জন্য ধীরে ধীরে গ্রিক ও ভারতীয় সারণিকে হটিয়ে দেয়। – এমনকি চীনারাও তা ব্যবহার করতে থাকে। খলিফা মামুনের মানমন্দির ছাড়াও সিরাজ, নিশাপুর, সমরখন্ডের মতো আরো অনেক শহরেও জ্যোতিবিদ্যার চর্চা অব্যহত ছিল. আল বাত্তনি (৮৭৭-৯১৮) টলেমিকে সংশোধন করে চাঁদ ও গ্রহসমূহের কক্ষপথ আরো সুক্ষভাবে পরিমাপ করেন এবং গ্রহণের কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। গজনীর সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় আলবিরুনি (৯৭৩-১০৫০) জ্যোতিবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এই অক্ষেয়বাদী শিয়া দার্শনিক ভারতীয় দর্শন ও বিজ্ঞান আরব জাতিকে সম্যকভাবে পরিচিত করান। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে অবশ্য সবচেয়ে পরিচিত নাম মুসলিম বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম (১০৩০-১১২৩), যদিও তার কবিখ্যাতি ছাড়িয়ে গেছে গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ খৈয়ামকে। মুক্তবুদ্ধির ধারক এই সংশয়ী কবি কিন্তু কাব্যচর্চা করতেন গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ফাঁকে ফাঁকে। বার্ট্রান্ড রাসেল খৈয়ামকে অভিহিত করেছেন তার জানা মতে একমাত্র কবি ও গণিতবিদ হিসেবে। ওমর খৈয়ামের প্রণীত ক্যালেন্ডার “তারিখ আল জালালী” গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও সুক্ষ ছিল। গ্রেগরিয়ান হিসেবে প্রতি ৩৩৩০ বছরে একদিন উদ্বৃত্ত হয়, অথচ খৈয়ামের হিসেবে তা প্রতি ৫০০০ বছরে একদিন। আব্বাসীয় জ্যোতির্বিদদের শেষ প্রজন্ম ছিলেন নাসিরুদ্দিন তুসি (১২০১-১২৭৪), যিনি বাগদাদ ধ্বংসের পর হালাকু খানের তৈরী মারাঘাহ মানমন্দিরের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এর সংশ্লিষ্ঠ পাঠাগারে প্রায় ৪ লক্ষ পুস্তক ছিল, যার কদর মঙ্গোল যাযাবরেরা না বুঝলেও লুটের মাল হিসেবে তারাই এগুলোকে নিয়ে এসেছিলো সিরিয়া, ইরাক, ইরান ইত্যাদি বিজিত দেশগুলো থেকে।
যে হিন্দু মনীষী খলিফা মামুনের দরবারে জ্যোতির্বিদ্যার বই “সিদ্ধান্ত” নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই আরব জাতিকে পরিচিত করান ভারতীয় গণিত ও সংখ্যাতত্ত্বের সাথে। এর ফলেই পরবর্তীকালে আরবদের মাধ্যমে ইউরোপ পরিচিত হয় দশমিক পদ্ধতি ও শূন্যের ব্যবহার সম্পর্কে। যদিও প্রথম দিকে আরব গণিতবিদরা এই নতুন ধারণাকে সহজে গ্রহণ করতে চাননি, তবে পরবর্তীকালে তারা এতে অভ্যস্ত, এমনকি বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সুবিখ্যাত গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারেজমি (৭৮০-৮৫০) ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ক তার গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেন, যা দ্বাদশ শতকে “ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্ব” নামে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। এর ফলেই ইউরোপীয় গণিতবিদরা জটিল রোমান পদ্ধতির বদলে সহজতর ভারতীয় সংখ্যা-পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেন। এছাড়াও আল খাওয়ারেজমি পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি – ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তার প্রণীত প্রায় ৮০০টি উদাহরণ সম্বলিত পুস্তক “হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ” দ্বাদশ শতকেই ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়. এটি ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রধান ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মূল পাঠ্যবই ছিল। গণিতবিদ ওমর খৈয়াম পরবর্তীকালে খাওয়ারেজমির রচনাকে আরো পরিণত রূপ দেন। এখনও আলজেব্রা আরবি নামই বহন করছে। খলিফা মামুনের দরবারে প্রণীত তৎকালীন পৃথিবীর মানচিত্র প্রণয়নেও খাওয়ারেজমি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, যাতে তাকে আরো ৬৯ জন বিজ্ঞানী সহায়তা প্রদান করেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের আরো যে শাখাটির সূত্রপাত আরবদের হাতে এবং এখন পর্যন্ত আরবি নাম বহন করছে, তা হচ্ছে রসায়ন বা আলকেমি। রসায়নের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান এই যে গ্রিকদের মতো তা শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয় – আরবরাই রসায়নে প্রথম ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রচলন করে. আরবি রসায়ন বিদ্যা আলকেমির জন্ম জাবির ইবনে হায়ানের হাতে, ৮ম শতকের শেষ দিকে। তার পূর্বগামী গ্রিক বা মিসরীয় বিজ্ঞানীদের মতোই জাবির মনে করতেন যে তামা-লোহা-সিসার মতো ধাতুকে কোনো একটি রহস্যজনক রসায়নের মাধ্যমে মূল্যবান সোনা বা রুপাতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। এ ধরণের পরশপাথরের সন্ধানই উপজাত হিসেবে জন্ম দেয় রসায়ন শাস্ত্রের। তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক বিদ্যা – এই দুইয়ের প্রতিই জাবির সমান গুরুত্ব আরোপ করতেন। তার মৃত্যুর দুশতক পর তার জন্ম ও কর্মস্থল কুফা শহরে একটি রাস্তা নির্মাণকালে খুঁড়াখুড়ির সময় তার ধ্বংসপ্রাপ্ত পরীক্ষাগার আবিষ্কৃত হয়, যাতে একটি থলে সোনার একটি বড় টুকরা তখনও পড়ে ছিল. পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে তখনকার যুগে অজানা অনেক রাসায়নিক যৌগ জাবির আবিষ্কার করেছিলেন। এছাড়াও তিনি জারণ-বিজারণ-পাতন -গলন -উদ্বায়ন -স্ফটিকীকরণ ইত্যাদি অনেক রাসায়নিক পদ্ধতিই পরিশীলিত করেন। জাবিরের অসমাপ্ত কাজ পরবর্তীকালে আরো অনেক আরব রসায়নবিদ এগিয়ে নিয়ে চলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইরানী কবি আল তুঘরাই এবং আবুল কাসেম আল ইরকি, যারা ছিলেন যথাক্রমে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের। প্রধানত পরশপাথর অথবা মৃতসঞ্জীবনী সুধা আবিষ্কারের উম্মাদনাই রসায়নবিদ্যা চর্চার লক্ষ্মী হিসাবে কাজ করেছে।
স্পেনের মুর-আরব সভ্যতা যদিও মূল আরব সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে স্বতন্ত্র পরিসরে বেড়ে উঠেছে, তবু তা অনেক খ্যাতনামা দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পৃথিবী যে গোলাকার – পুরোনো এ গ্রিক ধারণা মধ্যযুগে আরব বিজ্ঞানীরাই জীবিত রাখেন; তা না হলে রেনেসাঁর সময় নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের প্রেরণা কেও পেতেন না। আরব ভূগোলবিদরা টলেমির বিশ্বতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে এর পরিবর্তে এরিস্টটলের ধারণাকে সমর্থন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ স্পেনিশ মুসলিম বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আল মাজরিকি (১০০৭ সাল ), আল জারকিলি (১০২৯-১০৮৭), ইবনে আফলা (১১৪০-) প্রমুখ। টলেমির পরিমাপ মতে ভূমধ্যসাগরের বিস্তার ছিল ৬২ ডিগ্রী, আল খাবারেজমি তা কমিয়ে ৫২ ডিগ্রী নির্ধারণ করেন, কিন্তু তার সঠিক পরিমাপ করেন আর জারকিলি (৪২ ডিগ্রী )। রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস তার যুগান্তকারী বইটিতে আল জারকিলি, আল বাত্তানি প্রমুখদের নাম উদৃত করেছেন। কর্ডোভা ও সেভিলের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যারা আবিষ্কার করেন যে বৃক্ষজগতেও রয়েছে স্ত্রী-পুরুষ লিঙ্গভেদ। দ্বাদশ শতকে আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল ফিলহাহ” উদ্ভিদ বিজ্ঞানের তৎকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই। এতে ৫৮৫ টি উদ্ভিদ নিয়ে আলোচনা এবং ৫০টি ফলের চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়। ভেষজবিদ হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত স্প্যানিশ ছিলেন মালাগায় জন্মগ্রহণকারী আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ (মৃত্যু ১২৪৮)। তার প্রণীত বইগুলোতে প্রায় ১৪০০ আইটেম উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপেও তার মূল বই অনূদিত হয়ে জনপ্রিয়তা পেতো।
স্পেনিশ চিকিৎসকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গ্রানাডার ইবনে খতিব, যিনি চতুর্দশ শতকের প্লেগে উজাড় হয়ে যাওয়া ইউরোপকে আশার আলো দেখান। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইউরোপ যখন প্লেগকে ঈশ্বরের অভিশাপ বিবেচনা করে তাকে মোকাবেলায় অসহায়, তখন ইবনে খাতিব প্রমান করেন যে প্লেগ একটি সংক্রামক রোগ, যাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আরব ইতিহাসের সবচেয়ে নামকরা শল্যচিকিৎসক ছিলেন একাদশ শতকের আবুল কাসেম আল জাহরাবি, যিনি ইউরোপে পরিচিত ছিলেন আবুল কাসিম নামে। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত খলিফা ২য় হাকামের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। শল্য চিকিৎসায় জীবাণুমুক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা, মূত্রপাথরের উন্নততর শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি তার অবদান। শল্যবিদ্যার ওপর তার রচিত পুস্তকই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত পাঠ্য ছিল – যা আধুনিক ইউরোপীয় শল্যবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। আবুল কাসেম যেমন শল্যবিদ হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন, তেমনি চিকিৎসক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন ইবনে জুহুর (১০৯১-১১৬২)। তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেভিলে এবং প্রখ্যাত দার্শনিক ইবনে রুশদের তিনি ছিলেন বন্ধু। ইবনে রুশদের অনুরোধেই ইবনে জুহুর তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল তায়সির” রচনা করেন। ইবনে রুশদ তার উচ্ছসিত প্রশংসা করে অবিহিত করেছেন গ্যালোনের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বলে। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন আল রাজি ও ইবনে সিনার সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে থাকার যোগ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী। মুসলিম যুগে ব্যবহৃত যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান জগতেও বহুল ব্যবহৃত, তার মধ্যে সুপরিচিত এলকোহল, এলকালি, আলকেমি, এলজেব্রা, জোলাপ, সিরাপ, সোডা, এন্টিমনি, জেনিথ, নাদির ইত্যাদি অসংখ্য আরবি শব্দ।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও তার অগ্রগতি একেবারে নিরংকুশ ছিল না। যুগে যুগেই তাকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। এই সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের পৃষ্ঠপোষক খলিফাগণ, যারা নিজেরাও ছিলেন মুক্তবুদ্ধির আলোকপ্রাপ্ত। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কেননা মানমন্দির, পাঠাগার, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থাপন ও পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করা ছাড়াও তারা ভূমিকা রাখতেন উগ্র ধর্মান্ধদের আক্রমণ থেকে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের রক্ষায়। খলিফা মামুনের দরবারে আল কিন্দি, সুলতান মুহাম্মদের দরবারে আল রাজি, বিভিন্ন রাজন্যের চিকিৎসক ইবনে সিনা, আল হাকামের সভাসদ ইবনে হাইসাম, আল মনসুরের দরবারে ইবনে রুশদ প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতার উদাহরণ অসংখ্য। আবার যে যুগে খলিফা মুতাওয়াক্কিল কিংবা আলহাদীর মতো গোঁড়া সুন্নী শাসক ধর্মীয় শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, সে সময়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা হয় প্রাণ ভয়ে পালিয়েছেন, অন্যথায় তাদের জ্ঞানচর্চা বন্ধ করতে হয়েছে। সেই সাথে তালাবদ্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-মানমন্দির-পাঠাগারের দরজা, ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান। মুসলিম স্বর্ণযুগের অবসানের কারণ হিসেবে যদিও অনেকে উল্লেখ করেন মঙ্গোল আক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী ক্রুসেড কিংবা অন্যান্য সামরিক পরাজয় – কিন্তু এ সবের চেয়েও বেশি দায়ী অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান, যেমন আল গাজ্জালীর সুফিবাদের প্রতি সমর্থন এবং বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা করা। যে মহান আব্বাসীয় খলিফাদের দরবারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছিল, সেই খলিফারা ছিলেন উদার মুতাজিলা মতবাদের পৃষ্ঠপোষক। এমনকি খলিফা মামুন ও মুতাসিম একে রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। উদার মুতাজিলা দর্শন ইসলামের মূলনীতিকে অস্বীকার না করেই নির্বিচার বিশ্বাসকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলো যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা। কিন্তু বিশ্বাস ও যুক্তির এই সংঘাতে শেষ পর্যন্ত জয় হলো বিশ্বাসেরই। যুক্তি ও উদার নৈতিকতা পরাস্ত হয়ে দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হতে বাধ্য হয়। ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল, ইমাম গাজ্জালী, আল আশারি, ওহাবীদের গোঁড়া ধর্মীয় উম্মাদনায়ই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলো। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের ওপর নেমে এসেছে খড়গ – আক্ষরিক অর্থেই। শুধুমাত্র খলিফা আলহাদীর সময়েই নাকি বাগদাদে পাঁচ হাজার ভিন্ন মতালম্বীকে হত্যা করা হয়, ধর্মের বিশুদ্ধতাকে রক্ষা করার অজুহাতে।
ধর্মকে বিজ্ঞানের হাত থেকে বাঁচাতে তাদের যুক্তি কি ছিল? এখানে সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হবে। ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে তাইমিয়ার মতে জ্ঞান হলো শুধু তাই, যা আমরা মহানবীর কাছ থেকে পেয়েছি। এর বাইরে যে কোন জ্ঞান হয় অসত্য, না হয় অপ্রয়োজনীয়। স্পেনিশ ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে মুসা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে বিজ্ঞান আমাদের ততটুকুই প্রয়োজন যতটুকু আমাদের ধর্ম পালনের জন্য জরুরি। একজন হাম্বল-অনুসারী দাহাবি বলেন, যারা প্রকৃতি বিজ্ঞানের চর্চা করছে বা করবে তাদের ধর্ম বিশ্বাস নষ্ট হবে এবং তারা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। ইবনে হাইসামের জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থের জ্যামিতিক চিত্রমালা ও অঙ্ক দেখে আবুল হাসান ইবনে ফারিস মন্তব্য করেছিলেন – এই সমস্ত বিমূর্ত রেখা, চিত্র ও সংখ্যার চর্চা যারা করে, তাদের ধর্ম বিশ্বাস দুর্বল। তাদের উচিত ধর্মবিরোধী এ সমস্ত চর্চা ত্যাগ করে, আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করা। ইবনে সালাহ ফতোয়া জারি করেন যে, সকল প্রকার দর্শন-বিজ্ঞান-যুক্তিবিদ্যার চর্চা প্রথমে জন্ম দেয় বিভ্রান্তির, পরে তা কারণ হয় ধর্মদ্রোহিতার। কাজেই যারা এ সমস্ত চর্চা করছে তাদেরকে হয় বিশুদ্ধ ইসলামের পতাকাতলে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে – অন্যথায় তাদের গর্দান নিতে হবে। তাজউদ্দীন সুবকি বলেন, যুক্তি ও দর্শন শুধুমাত্র তাদেরকেই চর্চা করতে দেয়া যেতে পারে, যারা ধর্মতত্ত্বে ইতিমধ্যে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তাদের এই সংগ্রামকেই শেষ পর্যন্ত বিজয়ের চূড়ান্ত বেদিতে পৌঁছান ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম গাজ্জালী। জনৈক ইসলামী চিন্তাবিদের মতে, ইমাম গাজ্জালী “ধর্মকে রক্ষা করেছেন বিজ্ঞানকে পরাস্ত করে।” সন্দেহ নেই, যোগ্য পুরস্কার হিসেবেই তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে “হুজ্জাতুল ইসলাম” বা ইসলাম ধর্মের রক্ষক। কার্যকরণ সম্পর্ক অস্বীকার করে, জগতের প্রতিটি নৈমিত্তিক ঘটনার দায়িত্ব ঈশ্বরের উপর অর্পণ করে, ইবনে সিনা-ফারাবীর মতো বরেণ্য দার্শনিকদের অভিসম্পাত দিয়ে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিজয় পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চাতো বটেই, এমনকি গণিত ও জ্যামিতির মতো বিমূর্ত বিষয় চর্চাকেও তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা এতেও প্রচ্ছন্ন বিপদ লুকানো রয়েছে, যা পরবর্তীকালে ধর্মদ্রোহিতার জন্ম দিতে পারে।
মুসলিম বিজ্ঞানী ও মনীষীদের ওপর এই গোঁড়া ধর্মান্ধদের খড়গ ক্ষমাহীনভাবে নেমে এসেছে। ইবনে হাইসাম, ওমর খৈয়াম প্রমুখ কালজয়ী বিজ্ঞানীদেরকে প্রকাশ্যে নাস্তিক অভিধায় অভিহিত করে নরকের শাস্তি প্রার্থনা করা হয়েছে। পার্সিয়ানদের বাইরে একমাত্র আরব বংশোদ্ভূত মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি, যিনি খলিফা মামুনের দরবারে উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক ছিলেন, পরবর্তীকালে গোঁড়া ধর্মান্ধ খলিফা মুতাওয়াক্কিলের অনুগ্রহ-বঞ্চিত হন। তাঁর লাইব্রেরী আল-কিন্দিয়া হয় বাজেয়াপ্ত এবং তিনি হন বেত্রদণ্ড প্রাপ্ত। সর্বজনমান্য এই প্রবীণ দর্শনিককে জনতার সামনে ৫০টি বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়। অনেকেই নাকি সে সময়ে উল্লাস প্রকাশ করে তার নির্যাতন সমর্থন করেছিল। এই ঘটনার পরও তিনি প্রায় এক যুগ বেঁচে ছিলেন, কিন্তু মানসিকভাবে সেদিনই তার মৃত্যু হয়েছিল – তিনি আর কোনদিন জনসমক্ষে আসেননি।
ইবনে সিনা, যিনি ইমাম গাজ্জালী কর্তৃক অমুসলিম গ্রিক দর্শন চর্চা ও প্রসারের জন্য আখ্যায়িত হয়েছিলেন ধর্মদ্রোহী বলে, তাকে দরবার থেকে দরবারে নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তিনি নাকি মৃত্যুর পর দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন না, এ রকম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয়েছিল। ইবনে সিনা অবশ্য তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন – আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি নিন্মোক্ত কবিতাটি লিখেছিলেন –
”আমাকে ফেলতে চাও যারা ধর্মদ্রোহীদের দলে, তারা শোনো –
আমার অধিক বিশ্বাসে দৃঢ় তোমাদের মাঝে নেই কোনো।
আমাকে করতে পারো যদি ধর্মে অবিশ্বাসী বলে প্রমান
তবে সারা পৃথিবীতে একজনও নেই খাঁটি মুসলমান।”
ইবনে রুশদ তার সমসাময়িক ধর্মান্ধ মুসলমানদের উত্থাপিত অভিযোগে খলিফা আবু ইউসুফ কর্তৃক নির্যাতিত হন। খলিফার নির্দেশে তার দু-একটি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান সম্পর্কিত রচনা ব্যতীত প্রায় সমস্ত পুস্তক নিষিদ্ধ করা হয়। কোন এক শুক্রবারে জুমার নামাজে ইবনে রুশদ ও তাঁর পুত্রকে নামাজ পড়তে না দিয়ে খলিফা স্বয়ং তাকে পথভ্রষ্ট বলে ধিকৃত করেন। তার ভাগ্যে জোটে সমবেত জনতার লাঞ্ছনা। নির্বাসন, বন্দিত্ব, পলায়ন – সবকিছু ভোগ করে তিনি মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন পূর্বে তার স্বপদে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। ব্যাপক মানসিক আঘাতে ভেঙে না পড়ে তিনি তা সহ্য করতে পেরেছিলেন হয়তো তিনি একজন দার্শনিক ছিলেন বলেই।
সবচেয়ে করুন সম্ভবত মহান চিকিৎসক আল রাজির নির্যাতনের ঘটনা। প্রত্যাদেশে অবিশ্বসী রাজি বিশ্বাস করতেন যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিতে – যা ঈশ্বর নিজের প্রজ্ঞার অংশ থেকে মানুষের মধ্যে রোপিত করেছেন, যা তাকে বিশ্বদর্শনে সাহায্য করে। তার এ বিশ্বাসের জন্যই তাকে চরম মূল্য দিতে হয় – বুখারার আমিরের নির্দেশে আল রাজি তারই রচিত বই দিয়ে মাথায় প্রহৃত হন। আমিরের নির্দেশ ছিল যতক্ষন না মস্তক কিংবা বই, দুটোর একটা ছিন্ন না হয়, ততক্ষন পর্যন্ত এই প্রহার চালিয়ে যাওয়ার। এর ফলে রাজি তার দৃষ্টিশক্তি হারান, হারান জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ – এমনকি বেঁচে থাকার ইচ্ছাও। পরবর্তীকালে একজন বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক চিকিৎসা করে তাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন; কিন্তু রাজি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন – “আমার এই দুটো চোখ দিয়ে আমি ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক কিছু দেখেছি। আমার আর এর চেয়ে বেশি কিছু দেখার সাধ নেই।” এ পৃথিবীর প্রতি তার মনে যে অভিমান বাসা বেঁধেছিলো, সে অভিমান নিয়েই মধ্যযুগের প্রথিতযশা চিকিৎসক দৃষ্টিহীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন।
তাঁর এ অভিমানের পিছনে যে ধিক্কার লুকানো ছিল, তাই কি আল রাজির উত্তর পুরুষেরা আজো বহন করে চলেছে?
ধন্যবাদ
শুভ্রনীল ব্রহ্মচারী
সাম্প্রতিক মন্তব্য