চর্যাপদ বিতর্ক : কেন এটা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন নয় !

বাঙলা সাহিত্যের একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থী হিসেবে জেনে এসেছি, পড়ে এসেছি, শুনে এসেছি, বলে এসেছি এবং পরীক্ষায় খাতায় লিখে এসেছি “চর্যাপদ হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন ও ১ম নির্দশন” এবং এর ভাষা বাংলা। আমাদের এপার বাংলা আর ওপার বাংলার প্রায় সকল পন্ডিতগণ বলে গেছেন যে, “চর্যা বাঙলা ভাষার প্রাচীন নির্শন” যা মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশ করেছি আমরা সকলে। কিন্তু চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, এটা বাংলা ভাষাভাষীরা ছাড়া আর কি কেউ বিশ্বাস করে? হিন্দি ভাষিকরা, অসমিয়ারা, উড়িয়ারা, নেপালিরা, বিহারিরা, তিব্বতি পন্ডিতগণ? না, কেউ বিশ্বাস করেনা যে চর্যার ভাষা বাংলা। কারণ আমরা তেমন কোন প্রমাণ দিতে পারিনি যে, চর্যা বাঙলাতে রচিত। এমনি দাবি করে মগহি, ভোজপুরিয়া আর নেওয়ারিরাও। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যার কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি পুরো নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন নানাবিধ যুক্তি দিয়ে।
:
ব্যাকরণে না জানা তত্ত্বকে যেমন “নিপাতনে সিদ্ধ” বলে ধামাচাপা দেয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে, তেমনি চর্যার ভাষাকে বাংলা প্রমাণ করতে না পেরে আমাদের পন্ডিতগণ বলে গেছেন – “আলো আঁধারি ভাষা”, “সান্ধ্য ভাষা”, “প্রহেলিকাময় ভাষা” আরো কত কি? একজন বাঙালি ও বাংলা ভাষিক মানুষ হিসেবে চর্যা বাংলা ভাষার প্রাচীন নির্দশন হলে, ৭ম/৮ম বা নবম শতাব্দিতে বাংলা ভাষার কোন নিদর্শন পাওয়া গেলে খুব খুশি হতাম আমি। কিন্তু আমার ধারণা বাঙলা ভাষার আদি নির্দশন নয় চর্যাপদ। অসমিয়া, হিন্দি, নেপালি,ওড়িয়া, বিহারি, মৈথিলি ও তিব্বতি ভাষাবিদগণ চর্যাকে তাদের নিজ নিজ ভাষার বলে দাবী করেন। আমার কাছে তাদের দাবীকে অযৌক্তিক বলে মনে হয় না অন্তত বাঙালির দাবীর চেয়ে। যা নিচে বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানিক পরিমন্ডলে!
:
যুক্তি-১ : প্রাপ্তিস্থান
———————–
নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালার “অভিলিপিশালায়” পাওয়া যায় বাংলা দাবীকৃত চর্যার পুঁথি। এটা যদি বাংলা হতো, তবে পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার কোথাও না পেয়ে নেপালে কেন পাওয়া গেল, তা যৌক্তিক প্রশ্ন নয় কি? নেপাল রাজদরবারে কোন বাংলা কবি কখনো ছিলেন এমন কথা ইতিহাস প্রমাণ করেনা। হুমায়ুন আজাদের লেখা ৫০০/৬০০ বছর পর বাঙলা অঞ্চলে না পেয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে কি পাওয়া যাবে? কিংবা টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জের এ কালের কবি “ওতি মারাতুর” কাব্যগন্থ কি মিলবে ৬০০ বছর পর বীরভূম বা দিনাজপুরে? তাই হয়তো শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে এই ধরণের শতাধিক “নেপালি ভাষার” পদ উদ্ধার করেছেন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে।
:
যুক্তি-২ : চর্যার কবিদের নাম
———————————–
লক্ষ্যণীয় চর্যার কবিদের নাম। ঢেণ্ঢণ পা, চাটিল পা, ভুসুকু পা, লুই পা, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী হচ্ছে চর্যার কবি। বাংলা অঞ্চলে ৭ম/৮ম বা নবম শতাব্দীতে কি কখনো ছিল এমন নাম? না তখন ছিল, না এখন আছে! বাঙালিদের নাম কখনো এমন ছিলনা। হ্যা নেপালে পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে এখনো ঢেণ্ঢণ, চাটিল, ভুসুকু, লুই, গুণ্ডরী, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, দারিক, ভাদে প্রভৃতি নাম বিদ্যমান। সুতরাং ধরা যেতে পারে এ কবিরা কেউ বরিশাল, মালদহ, ঢাকা কিংবা বর্ধমানের ছিলনা। কবিরা কেউ কেউ ঝাড়খন্ড, বিহার,নেপালের অধিবাসি ছিলেন বলে মানা যেতে পারে। তো একজন নেপালি বা বিহারের কবি কেন বাংলাতে চর্যাপদ লিখবেন?
:
যুক্তি-৩ : চর্যার ভাষা
———————————–
চর্যার ভাষাতে কিছু বঙ্গ-কামরুপি শব্দের দেখা মিললেও তসু, জৈসন, জিস, কাঁহি, পুছমি প্রভৃতি অনেক পশ্চিমা অপভ্রংশজাত শব্দ দৃশ্যমান। ভাষাবিদ ম্যাক্সমুলার ‘সন্ধ্যা’ ভাষার অর্থ করেছেন ‘প্রচ্ছন্ন উক্তি’ (‘hidden saying’)। আহ্মে, কাহ্ন, দিঢ় ইত্যাদি এবং ওড়িয়া-সুলভ ‘ল’ (l)-ধ্বনির খোঁজ মিলবে চর্যার পাতায় পাতায়। সুতরাং বাংলা শব্দ কমই বিদ্যমান চর্যাতে। তবে ‘বঙ্গাল দেশ’, ‘পঁউয়া খাল’ (পদ্মানদী), ‘বঙ্গালী ভইলি’ ইত্যাদির উল্লেখ থাকায় এটা বাঙালির রচনা এমনটা পুরো প্রমাণ করেনা। নেপালি বা তিব্বতি কবিরাও এ কথা বলতে পারেন। যেমন আমরা উপমায় “জিপসি রমণী” কিংবা “মরু বেদুইন” বা “কৃষ্ণ সাগর” ইত্যাদি চিত্রকল্প উল্লেখ করি।
:
যুক্তি-৪ : উপমা জীবনচিত্র
———————————–
উঁচু পর্বতে মযূরপুচ্ছ পরিহিত যে শবরী বালিকার কথা বলা হয়েছে চর্যাতে, যে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় আর গলায় পরে গুঞ্জা ফুলের মালা। ‌‌’গুঞ্জা’ নামে কোন ফুল নেই বাংলাতে কিংবা ছিলনা। বাঙালি মেয়েরা চুলে কখনো ময়ূরপুচ্ছ পরেনা, ময়ূর পাওয়া যায়না বাংলা অঞ্চলে। আর সমতল বাংলায় পাহাড় কই? বরং এ দৃশ্য নেপাল, তিব্বত বা ঐ জাতীয় পাহাড়েই হওয়া সম্ভব! বেশির ভাগ চর্যার ডোম-ডোমনি, শবর-শবরী, নিষাদ-কাপালিক এদের কথা বলা হয়েছে। এরা সমতল বাংলার দৃশ্যপটের বাইরে হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
:
যুক্তি-৫ : চর্যার জীবনবোধ ও প্রজ্ঞাময়তা
————————————————–
বাঙালিরা যখন মধ্যযুগে মাত করেছিল “রূপবান রহিম বাদশা তাজেলের কিসসা” কিংবা “গহর বাদশা বানেছা পরীর” রূপকথায়, “রাখালের পিঠাগাছের” গল্পের বাইরে যখন বাঙালির চিন্তন ছিলনা, তখন কিভাবে চর্যার মত এতো উচ্চমার্গের সাহিত্য রচিত হতে পারে বাঙালির হাতে! চর্যার কবিরা যুক্তিবাদী ও মননধর্মী নির্ধামিক নাস্তিক ছিলেন বলে উপমা-রূপকের ব্যবহারে চমকপ্রদ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অতলান্তিক নিপুণতায়। তাঁদের রচনাশৈলী শিল্পসৌকর্যের অভিমুখী। তাঁদের বাকরীতি সংক্ষিপ্ত, অথচ নিগূঢ় অর্থবাহী। চর্যাপদের লৌকিক জগৎ, উপমা ও রূপক, মানবপ্রেমিক অভোগবাদি ধর্মমত, ভাষাগত বিশেষত্ব এবং এর অনুবৃত্তি এক পুষ্পিত মার্গের চিত্র উপস্থাপন করে। এর আলংকারিক, ভাষিক, কাব্যিক ও দার্শনিক প্রবণতায় রয়েছে কালোত্তর সেই সব লক্ষণ, যা বিভাষী ও বিজাতি হৃদয়কেও অভিভূত করে। চর্যার প্রভাবসঞ্চারী বহুস্তরী অর্থের ব্যঞ্জনা, গভীর কাব্যবোধ, উপমা ও রূপকের আলংকারিক প্রাচুর্য। চর্যাপদের মূল সৌন্দর্য বাচ্যার্থের প্রচ্ছন্নতায়, দার্শনিকতা ও তান্ত্রিক সাধনাকে উপমা ও রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশের জটিলতায়। আর এর আত্মা সতত স্পন্দিত কাব্যের সৌন্দর্যবোধে।
:
ডোম্বীপার ১৪নং পদ – “বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা। সদ্গুরু পাঅ পসাএ জাইব পুণু জিনউরা” মানে “ডোমনি নদী পারাপার করছে, আর তারই মাধ্যমে সহজ সাধনার তীর্থধামে পৌঁছানোর আভাস সূচিত হচ্ছে”। কুক্কুরীপাদের মতে, এক কোটি লোকের মধ্যে একজন চর্যার গূহ্যার্থ অনুধাবনে সক্ষম। চর্যার কথা লৌকিক অর্থের বদলে সংকেতে আবৃত হওয়ায়, তা সর্বসাধারণের বুদ্ধির অগম্য। এর দ্বৈতার্থের কয়েকটি নিদর্শন হলো: নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থে ‘চন্দ্র’, চিত্ত অর্থে ‘হরিণ’, জ্ঞানমুদ্রা অর্থে ‘হরিণী’, মহাসুখকায় অর্থে ‘নৌকা’, শবরী অর্থে ‘দেবী নৈরাত্মা’ ইত্যাদি। কাহ্নপার ১০ নং চর্যায় পাই “নগর বাহিরে যে ডোম্নী তোহেরি কুড়িয়া। ছোই ছোই যাইসি ব্রাহ্ম নাড়িয়া। অর্থাৎ রে ডোম্নী নগরের বাইরে তোমার কুঁড়েঘর, ব্রাহ্মণ নেড়াকে তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। আবার সমাজ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদও আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চর্যায়। ঢেণ্ঢণের পদে দেখা যায়– “টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।” অর্থাৎ- “টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে”।
:
চর্যার কোন কোন পদে নিছক দর্শনকথা অসামান্য চিত্ররূপের মাধ্যমে বর্ণিত উঠেছে। চাটিলপা যখন বলেন– “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী।” (“ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান। তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল”)। আবার এ চর্যাতেই কখনও বা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যে প্রহেলিকার অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলিও অসামান্য সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যেমন: কুক্কুরীপাদের পদ– “দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই। / রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ।।” (“মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে”।) কাহ্নপাদের দু’টি পঙ্ক্তি- “মন তরূ পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা॥ আসা বহল পাত ফল বাহা”॥ (মন হলো তরু, পঞ্চ ইন্দ্রিয় তার শাখা, আশা বহুবিধ পত্রের ও ফলের বাহক)। আহ! কি নান্দনিক দর্শনতাত্ত্বিক কথা! বাঙালিরা বলেছে এসব? তাহলে এখন বাঙালির বোধে এতো তুচ্ছতা আর ঋণাত্মকতা কেন?
:
চর্যায় কোন যুদ্ধ কিংবা রাজা-রানীর কিসসা নেই, প্রেমাশ্রয়ী; চর্যাপদ সেখানে প্রেম নয়, বরং শরীরী অভিব্যক্তিকে আশ্রয় করেছে তান্ত্রিক সাধনার উপায় হিসেবে। আধুনিক মননের কবি অক্টাবিও পাসের ভাষায় – ‘আমরা যাকে প্রেম বলি, তন্ত্রবাদ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ, তার যৌনকামনা হচ্ছে এক ধরনের ধর্মীয় আচার। ’ (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Editorial Joaquin Mortiz, Mexico, Febrero 1986, P 80)। অর্থাৎ প্রেম ও আখ্যাননির্ভরতা, যে সময় প্রায় সব ভাষার ক্ষেত্রেই ছিল ধ্রুবাচার, চর্যাপদ সেই পথ এড়িয়ে প্রবেশ করেছিল দেহের জটিল অরণ্যে, কায়া যেখানে ‘তরুবর পঞ্চবি ডালি’। যেখানে পরস্পর আলিঙ্গনে প্রস্ফুটিত (তিঅড়া চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী), যেখানে একে অপরকে চুম্বন করে কমলরস পানে (তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি) তৃপ্ত হয়। চর্যাপদগুলোতে দেহ ফিরে এসেছে বারবার মানবিক কামজ বাসনা নিয়ে, আর প্রতিবারই তা অর্থের নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে মানবিক সুখবাদে। হয়তো চর্যার ধর্মমুক্ত কবিদের জন্যেই এমনটা হয়ে থাকবে।
:
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায়, নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রায়ণ- “উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী/ মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।/ উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। /ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।। /ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী”। যা আধুনিক বাংলাতে বলা যায় – “উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো”। সন্দেহ নেই যে দৈহিক সম্ভোগের বিষয়টি চর্যাগীতিতে এসেছে তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সূত্রে, চর্যার কবিরা এক আদিতম দেবতার শরীরী সম্ভোগকে সংস্কারের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, হয়তো তারা মুক্তমনা নাস্তিক ছিলেন বলেই। পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাচীন লিরিকে এমন শরীরী সংরাগ উন্মোচনের নজির দুর্লভ, যা চর্যাতে দিপ্তমান পদে পদে।
:
চর্যাপদ শুধু আধেয়-বৈভবেই নয়, এর আলংকারিক নৈপুণ্য ও বাচনিক কুশলতা বাস্তব ও বিভ্রমকে অভিন্ন কররেখায় দার্শনিক প্রতীতি বয়ানেও কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। চর্যার কবি যখন বলেন, ‘উদক চান্দ জিম সাচ না মিচ্ছা’ (জলের চাঁদ যেমন না সত্য না মিথ্যে), তখন আধুনিক জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ কিংবা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার উপমা উৎপ্রেক্ষাকে এক জলান্তিক দ্যোতনায় উদ্ভাসিত করে। জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতি ও নেতির এক পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসকে বন্ধনের মাধ্যমে চর্যাপদ বাস্তবের অদৃশ্য স্তরকে আবিষ্কারে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেছে এর কবিরা। আলংকারিক সৌন্দর্যে মোড়ানো ভাবুকতার বিরল দীপ্তি নক্ষত্রের মতো বিকিরিত হতে দেখি চর্যার শরীর থেকে। চর্যাপদর প্রবাদপ্রতিম একটি পংক্তি হচ্ছে, ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’, আরেকটি প্রবাদপ্রতিম নয় কিন্তু আলংকারিক বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ : ‘জোইনি জালে রঅনি পোহাই’। প্রথম উদ্ধৃতিটিতে ব্যক্তির সৌন্দর্য ও দৌলত যে নিজেরই বিনাশের বীজ হয়ে ওঠে তা এই চিত্রকল্পটি অসামান্য সহজতায় তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটিতে আমরা এমন একটি রূপকের মুখোমুখি হচ্ছি, যার কাব্যিক সুষমা আমাদের অভিভূত না করে পারে না।
:
চর্যাপদই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র প্রাচীন কাব্য, যা সরাসরি তান্ত্রিক দর্শনকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল। তান্ত্রিক নিয়মাবলি আড়ালে রেখে দর্শনপ্রবণ হয়ে ওঠার মধ্যে মুক্তি খুঁজেছিল চর্যাপদের কবিরা। যে নিহিলিজম (Nihilism) পশ্চিমে ঊনবিংশ শতকে চিন্তাজগতে আলোড়ন তুলেছিল, তা হয়তো আবিষ্ট করেছিল চর্যাপদের কোনো কোনো কবিকেও, বিশেষ করে সরহপা কিংবা কাহ্নপাকে। চর্যাপদের আরেক কবি কৃষ্ণাচার্যপাদানাম নিহিলিজমকে আরো ব্যাপক ও প্রগাঢ় করে তুলেছেন, যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘স্বপণে মই দেখিল তিহুবণ সুণ,/ঘোরিঅ অবণাগবণ বিহুণ (স্বপ্নে আমি দেখিলাম ত্রিভুবন শূন্য,/ঘুরিয়া আনাগোনা বিহীন)। চর্যাপদ দার্শনিক দৌলতে যতটা ঐশ্বর্যময়, ঠিক ততটাই ঋদ্ধ ভাষা সম্পর্কিত দার্শনিক ভাবুকতায়। এক সমাজ বৈরি কালের উজান ঠেলে চর্যাপদের কবিরা কালোত্তর স্বভাবগুণে সমকালীন হয়ে আছে আজও। সুতরাং এর কবিরা বাঙালি হলে কিভাবে এমন বোধ আর প্রজ্ঞাময়তার মাঝে রচিত হতে পারে “রূপবান চিন্তক” বাঙালি!
:
এবং এই ক্লাসিক জীবন কিংবা শিল্প এবং বৌধ্যিক স্লোগানের শৈল্পিকতার মানদণ্ডে চর্যা অবশ্যই উচ্চমার্গের এক সাহিত্য, যার দেখা পাইনা আমরা পয়ারছন্দের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলাকাব্য, গীতি কবিতা কিংবা ইসুফ জোলেখায়’। সুতরাং বাঙালির প্রাচীন যুগের সাহিত্য শূন্য এ দুঃখের শ্লোকে বাঁধা অতলান্তিক জীবন বৃক্ষকে না ঢাকি আমরা চর্যার মত এক হৃদয়ঘন ভালবাসাময় পাঁচিলঘেরা স্বর্ণদেয়ালে। যে দেয়ালের অলিন্দে হাঁটে চর্যাকে নিজ সম্পদ দাবী করার নষ্ট বীজের ভ্রষ্ট চতুরতা। তাই চর্যাকে বাদ দিয়েই রচিত হোক বাঙলা ভাষা আর বাঙলা সাহিত্য! চর্যাকে থাকতে দেই তার আপন ভুবনে চর্যার মতই!

You may also like...