চোখের বিবর্তন (The evolution of Eye) প্রথম অংশ
শীর্ষ ছবি: মানুষের চোখ ( ফটোগ্রাফ : Dan Saelinger/ Eye-Bank For SightRestoration, NY / Scientific American)
লেখাটি দীর্ঘ সুতরাং এটি দুটি অংশে আসছে, ধন্যবাদ
মুল :Trevor D. LambএরThe Evolution of Eye (Scientific American;, July 2011) অবলম্বনে; বাড়তি তথ্যসুত্র: Evolution of the vertebrate eye:opsins, photoreceptors, retinaand eye cup: Trevor D. Lamb, Shaun P. Collin and Edward N. Pugh, Jr. Nature Reviews: neuroscience; volume 8, December 2007এবংThe Origin of the Vertebrate Eye. Trevor D. Lamb & Edward N. Pugh Jr. & Shaun P. Collin Jr. Evolution: Education and Outreach (2008)
To suppose that the eye, with all its inimitable contrivances… could have been formed by natural selection, seems, I freely confess, absurd in the highest possible degree… Yet reason tells me, that if numerous gradations from a perfect and complex eye to one very imperfect and simple, each grade being useful to its possessor, can be shown to exist… and if any variation or modification in the organ be ever useful to an animal under changing conditions of life, then the difficulty of believing that a perfect and complex eye could be formed by natural selection, though insuperable by our imagination, can hardly be considered real. Charles Darwin
আমার কিছু কথা:
মেরুদন্ডী প্রানীদের চোখের মত সুক্ষ ও জটিল একটি অঙ্গ যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে, সেটা মেনে নেবার ক্ষেত্রে কিছু ধারনাগত যে সমস্যা আছে ডারউইন সেটা স্বীকার করেছিলেন তার যুগান্তকারী রচনা On the Origin of Species এ। কিন্তু তাঁর যুক্তি ছিল চোখের বিবর্তনের নানা পর্যায় বা ধাপগুলো যদি আমরা খূজে পাই ( তাঁর ভাষায় Numerous gradations, আদি চোখ থেকে বর্তমানে তথাকথিত perfect চোখের বিবর্তনে ) এবং যদি পর্যবেক্ষন করতে পারি যে এই সব পর্যায়গুলো ( তাদের নানা মাত্রার পরিবর্তন সহ) বহনকারী প্রানীদের জীবনধারনের জন্য কোন না কোন ভাবে উপকারে এসেছে ( তাঁর ভাষায় Survival advantage, তা যতই সামান্য হোক না কেন) এবং বংশানুক্রমে তা বিস্তৃত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মে, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে অবোধ্য এই ধারনাগত সমস্যটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। এ বিষয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছেন জীববিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গ্রুপ (অষ্ট্রেলিয়ার জীববিজ্ঞানী ডঃ ট্রেভর ডি. ল্যাম্ব এমন একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন); বিজ্ঞানীরা বহুদিন আগেই প্রমান করেছেন মেরুদন্ডী প্রানীদের চোখ আসলেই এরকমই অসংখ্য Numerous gradations বা পরিবর্তনের মাধ্যমেই তার বর্তমান রুপ পেয়েছে। এই সব নানা ধাপের অনেকগুলোর সরাসরি প্রমান পাওয়া যায়নি, জীবাশ্ম রেকর্ড বা তার প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোন জীবিত প্রানীর মধ্যে; কিন্তু সেই ধাপ গুলো সুস্পষ্ট প্রমান মিলেছে বিবর্তন জীববিজ্ঞানের নানা শাখায়, বিশেষ করে গত দশকে, যখন Evolutionary Development Biology (বা Evo Devo) র ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এবং আরো সুনির্দিষ্ট প্রমান সংগ্রহের লক্ষ্যে অব্যাহত আছে গবেষনা । ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গ্রুপের পাওয়া নানা তথ্য একসাথে করে ডঃ ট্রেভর ল্যাম্ব বেশ কয়েকটি রিভিউ লিখেছেন (তথ্যসুত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এমন কয়েকটি পেপারের), নীচের এই লেখাটি তিনি তার সেই বৈজ্ঞানিক রিভিউগুলোকে একটু সহজবোধ্য করে সবার জন্য লিখেছিলেন Scientific American এর এ বছরের জুলাই সংখ্যায়। আমি সেটাকেই চেষ্টা করেছি ভাবানুবাদ করতে। ডায়াগ্রাম এবং বেশ কিছু তথ্য আমি অবশ্য সরাসরি তার অন্য রিভিউগুলো থেকে সংগ্রহ করেছি। ট্রেভর ল্যাম্ব এর রিভিউ ছাড়াও বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক রিভিউ আছে; যেহেতু তাদের মুল কথা একই,শুধুমাত্র গবেষনার দৃষ্টিকোন থেকে গুরুত্বপুর্ণ আর গবেষক ছাড়া আমাদের অনেকের জন্য তা অপ্রয়োজনীয়, সেকারনে আমি শুধুমাত্র ট্রেভর ল্যাম্বকে অনুসরণ করেছি এখানে।
(ট্রেভর ডি. ল্যাম্ব John Curtin School of Medical Research এর নিউরোসায়েন্স বিভাগ এবং Australian National University র ARC Centre of Excellence in Vision Science এর একজন গবেষক, এছাড়া তার সহযোগীরা হলেন শন পি. কলিন (University of Queensland, School of Biomedical Sciences, Brisbane,Austrlia) এবং এডওয়ার্ড এন. পাগ (F.M. Kirby Center for Molecular Ophthalmology, University of Pennsylvania, USA))। পরিভাষার সমস্যা তো আছেই, সে কারনে কোন প্রশ্ন থাকলে ধৈর্যশীল পাঠকদের অনুরোধ করবো, যেন মন্তব্যর জায়গায় বা আমাকে সরাসরি ইমেইলের মাধ্যমে আমাকে জানাতে ইতস্তত করবেন না)
শুরুর কথা:
মানুষের চোখ অত্যন্ত সুক্ষ এবং জটিল একটি অঙ্গ। ক্যামেরার মতই আমাদের চোখ আলো সংগ্রহ করে, সেই আলোকে ফোকাস করে এবং তারুপান্তরিত করেস্নায়বিকতড়িৎ সংকেতে যা আমাদের ব্রেন রুপান্তরিত করে ছবিতেএবংতা দৃশ্যমান করে তোলে আমাদের সামনে।কিন্তু ফটোগ্রাফিক ফিল্ম এর বদলে, চোখের আছে খুবই বিশেষায়িত একটি স্নায়ুকোষের স্তর, যার নাম রেটিনা।খুবইসংবেদনশীল এই রেটিনা আলোক সংকেতকে শুধু শনাক্ত করতেই সক্ষম না, এছাড়াও রেটিনার মধ্যেইউপস্হিত প্রায় ডজন খানের বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের মাধ্যমে, রেটিনা সেই সংকেতকে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের ব্রেনেরজন্যপাঠযোগ্য করেকরে তোলে। চোখের মধ্যেএতই সুক্ষতা যে,এর উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়টি বহুদিনধরেইসৃষ্টিবাদী আরইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন প্রস্তাবকরা তাদের স্বপক্ষে যুক্তির একটি অন্যতমশ্রেষ্ঠ উদাহারন ( বা Cause Célèbre)হিসাবে ব্যবহার করে আসছে ।তারা চোখকে ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি ( Irreducible complexity)অর্থাৎ কোন একটি ক্ষুদ্রতমঅংশ ছাড়া কর্মক্ষম না এমন কোনএকটি সিস্টেম বা অঙ্গর শ্রেষ্ঠতমউদহারন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে অর্থাৎ তাদের যুক্তি হলো কোন প্রিমিটিভ বা খুব আদি কোন রুপবা অন্তবর্তীকালীন কোন পর্যায় থেকেচোখ প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তিতহয়েবর্তমান রুপে পেতে পারে না।এমনকি চার্লস ডারউইন নিজেই সমস্যাটাকে স্বীকার করেছেন তার ১৮৫৯ সালে তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে লেখা অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইটিতে; প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই চোখের মত কোন অঙ্গ তৈরী হয়েছেসে বিষয়টাআপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হতে পারেচিন্তাটা। কিন্তু ডারউইন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াতেই বিবর্তিত হয়েছে চোখ,যদিও সেইসময়েচোখের বিবর্তনে অন্তবর্তীকালীন কোনপর্যায়েরকোন উদহারন তার জানা ছিল না।
পরবর্তীতেও এর সরাসরি প্রমান পাওয়াটাকিন্তু বেশ সহজ হয়নি।অস্থি কাঠামো বা হাড়েরবিবর্তন নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম রেকর্ডে যেমন যেভাবে দ্রুত রুপান্তরেরসুস্পষ্ট প্রমানখুজে পান, নরম অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ক্ষেত্রে সেটা অনেক সময়ই সম্ভব হয়না কারন নরম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কদাচিৎজীবাশ্মে রুপান্তরিত হয়।এবং এমনকিযখন তারা জীবাশ্মীভুত হয়ও, সাধারনতঃ তখনওযথেষ্টপরিমান সুক্ষভাবে এর বিভিন্ন অংশগুলো জীবাশ্মীভুত হয় না, ফলে এধরনের জীবাশ্মপরীক্ষা করে বেশ কঠিন হয়ে যায়কিভাবেএটিবিবর্তিত হয়েছে সেই প্রক্রিয়াটাবর্ণনা করা।তাসত্ত্বেও জীববিজ্ঞানীরা সম্প্রতি চোখের বিবর্তনের ব্যাখ্যায় বেশ কিছু গুরুত্বপুর্ণ অগ্রগতি করেছেন। বিশেষ করে কিভাবে ভ্রুণাবস্হায় কিভাবে এটি তৈরী হয়,এবং বিভিন্ন ধরনেরপ্রজাতির মধ্যে চোখের গঠন এবং এর গঠনকারী জিনগুলোর তুলনামুলক গবেষনা করে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হয়েছেন বুঝতে : কখন এর প্রধান প্রধান বৈশিষ্টগুলোর আবির্ভাব হয়েছে।এসব গবেষনাগুলোর ফলাফল প্রমান করে যে,আমাদের চোখের মত চোখ,যা মেরুদন্ডী প্রানীদের মধ্যে সাধারনতঃ দেখা দেয়,তার আকৃতি পেয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছরের কিছুটা কম সময়ের মধ্যেইএবং প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে প্রাণীদের সারকাডিয়ান (দৈনন্দিন) রিদম এবং ঋতু বা সিজনাল রিদম নিয়ন্ত্রণকারী খুব সাধারন আলোক সংবেদী একটি অঙ্গ থেকেপ্রায়৫০০ মিলিয়ন বছর আগেএটি বিবর্তিত হয়েছে অপটিক্স এবং স্নায়বিক দিক থেকে অতি উন্নত এবং জটিল একটি অঙ্গে।ডারউইনের যুগান্তকারী প্রকাশনার ১৫০ বছরপর,অবশেষেএসব গবেষনালব্ধফলাফল এবং প্রমান,ডারউইনের প্রস্তাবনাকেপ্রমানিত করেইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটিধারনার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল। এছাড়া এসব গবেষনা লব্ধ ফলাফল এটাও ব্যাখ্যা দিল,কেন আমাদেরচোখ,একেবারে ভ্রান্তিহীন,সঠিক পরিকল্পনা আর প্রৌকশলের যাবতীয় গুনাবলী সম্পন্ন একটিযন্ত্র না হয়েবরং বেশ কিছু গুরুত্বপুর্ণ ডিজাইনসমস্যা সম্পন্নএকটি অঙ্গ হলো, যা বিবর্তন বিজ্ঞানী বহুদিন থেকে জানতেন।চোখের এই সবভুল বা ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন সমস্যাগুলোই বিবর্তনের চিহ্নবহন করে আসছে। অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে,কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলাফল কিন্তু কখনোই একেবারে ত্রুটিহীণ বা পারফেকশনে পৌছোনো না, কারন বিবর্তনের কোন প্রাক-পরিকল্পনা নেই।এর কাজই হলো হাতের কাছে যা উপাদান আছে সেগুলোকে গড়ে পিটে, পুর্নব্যবহার করে ঠিক করে নেয়া, সেকারনেইমাঝে মাঝে এরফলাফলগুলোঅদ্ভুত হওয়াটাও বিচিত্র না।
আমাদের চোখের কিভাবে উদ্ভব হয়েছে তা জানতে হলে অতি প্রাচীন কিছু ঘটনা সম্বন্ধে আমাদের আগে জানতে হবে। আমরা মানুষরা একটি অবিচ্ছিন্ন পুর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতার অংশ, যা বিস্তৃত সেই চার বিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতে জীবনের প্রথম যাত্রা থেকে। প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগে সাধারন বহুকোষী প্রানী দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়: এদের একগ্রুপে শরীরের বিন্যাস ছিল রেডিয়ালী সিমেট্রিকাল,অর্থাৎ একটি কেন্দ্রবিন্দুর চারপাশে এটি প্রতিসাম্য তৈরী করে,কেন্দ্র বরাবর বিভিন্ন সমতলে প্রানীকে যদি ভাগ করা হয় তবে প্রতিটি অংশ হবে অভিন্ন); এ ধরনের রেডিয়ালসিমেট্রির প্রানীদেহের কোন ডান বা বাম দিক নেই বা সামনে কিংবা পেছন দিক নেই ,এদের শুধু উপর এবং নীচ থাকে); আর অন্য গ্রুপটি, বাইল্যাটেরিয়া –যেখান থেকে উদ্ভব হয়েছে সেই সব অরগ্যানিজমরা যাদের আমরা প্রানী বলে ভাবি–ছিলবাইল্যাটেরালী বা দ্বিপার্শিক সিমেট্রির শারীরিক পরিকল্পনার। অর্থাৎ এদের বাম এবং ডান পাশ আছে,যারাএকে অপরের আয়নার প্রতিবিম্বের মত। এই বাইল্যাটেরিয়ারারা আবার প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছরে আগেবিভাজিত হয়েছে দুটি খুবই গুরুত্বপুর্ন গ্রুপে: যাদের একটি থেকে উদ্ভব হয়েছে বর্তমানে অমেরুদন্ডী প্রানীদের বিশাল একটি অংশ,আর অন্যগ্রুপটির বংশধর হলো মেরুদন্ডী প্রানীরা যাদের মধ্যে আমরা মানুষরাও আছি। এই দুটি বংশধারা পৃথক হবার পরপরই,বহু বিচিত্র দৈহিক পরিকল্পনা সহ নানা ধরনের প্রানীদের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছিল ব্যাপক হারে,ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরন নামে সুপরিচিতও বিখ্যাত যে ঘটনাটি তার চিহ্ন রেখে গেছে প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন থেকে ৪৯০ মিলিয়ন বছর আগের জীবাশ্ম রেকর্ডে ও ভুতাত্ত্বিক সময়ে । বিবর্তনের এইহঠাৎ বিস্ফোরনই জটিল চোখের বিবর্তনের প্রথম ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছরের আগে আদি প্রানীদের শরীরে একধরনের আলোক সংবেদী অঙ্গ বিবর্তিত হয়েছিল,যার আলোর উপস্হিতি টের পাবার ক্ষমতা ছিল;ধারনা করা হয় এর কাজ ছিল মুলতঃ আলো উদ্দীপনা ব্যবহান করে চলাচল, বা শিকারী প্রানীর আক্রমন বা প্রিডেশন থেকে বাচার জন্য ছায়া শনাক্ত বা ভার্টিকাল মাইগ্রেশন,এছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ শরীরের সারকাডিয়ান রিদম নিয়ন্ত্রনের জন্য। প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরনের সময়ই যখন প্রানীদের দেহের পরিকল্পনার খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়েছিল এবং ছবি গঠন কারী চোখ এবং তা বোঝার জন্য ভিজুয়্যাল সিস্টেমের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রানীদের এই উপকারী বৈশিষ্ট যেমন, দৃষ্টি, দ্রুত চলাফেরা করার গতি, দেহরক্ষার বর্ম সম্ভবত সেই সময় বেচে থাকার হাতিয়ার ছিল, যা একই সাথে সুচনা করেছিল আক্রমনের এবং প্রতিরক্ষার অস্ত্র প্রতিযোগিতায়।নানা পর্বের প্রানীদের মধ্যে চোখও বিবর্তিত হয়েছিল বিচিত্র ধরনের, কিন্তু তাদের ডেভেলপমেন্ট আর প্যাটার্ন এর মুল ব্যাপারগুলো একই রকম। তার কারন PAX6 এবং RAX(RX) এর মত জীনগুলো; যারা নিউরুলাশন এবং ব্রেন রিজিওনালাইজেশন সময় প্রধান ভূমিকা পালন করে।
ছবি: উপরের ছবিটিতে চোয়ালযুক্ত মেরুদন্ডী প্রানীদের (Jawed vertebrates) বিবর্তন দেখানো হয়েছে,মিলিয়ন বছর আগে’ সময়ের স্কেলে। ((ছবিতে শাখাবিভক্তি আর সময়ের হিসাব মুলতঃ বাহ্যিক বৈশিষ্ট এবং জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত ডাটার উপর ভিত্তি করে)) আদিম বাইলারেটাল প্রানীদের থেকে প্রায় ৫৮০ মিলিয়ন বছর আগে (মলিকিউল্যার ক্লক অনুযায়ী অবশ্য আরো আগে) প্রধান দুটি সুপার ফাইলাম ট্যাক্সা বিভক্ত হয়: প্রোটোস্টোমস (যার মধ্যে প্রায় সব অমেরুদন্ডী প্রানী) এবং ডিউটেরোস্টোমস (এর মধ্যে আমাদের পুর্বপুরুষরাও আছেন); ডিউটেরোস্টোমস শাখাটি থেকে পরে বিবর্তিত হয় কর্ডেট ( ডর্সাল নার্ভ কর্ড সহ যাদের নটোকর্ড আছে বা ভ্রুণাবস্থায় ছিল); মাথা খুলি বা স্কাল সহ প্রানীদের (ক্রেনিয়েটস) উদ্ভব ঘটে ৫৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে; বর্তমানে জীবিত ক্রেনিয়েটদের মধ্যে হ্যাগফিসের দৈহিক গঠণ সবচেয়ে প্রাথমিক স্তরের; যাদের না আছে চোয়াল না আছে মেরুদন্ড, সুতরাং তাদের তাদের মেরুদন্ডী বলা না হলে নিকটবর্তী সিস্টার গ্রুপের সদস্য মনে করা হয়। মেরুদন্ডী বা ভার্টিব্রেটদের দুটো প্রধান গ্রুপ: প্রথমে আসে আদি চোয়ালহীণ বা আগনাথান, যাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত প্রানী হলো ল্যাম্প্রে, পরে আসে চোয়াল সহ নাথোস্টোমরা, যাদের মধ্যে আছে মাছ এবং টেট্রাপডরা। সবচেয়ে প্রাচীন কর্ডেট, যাদের প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমানে জীবিত সেপালোকর্ডেট ও টিউনিকেটরা, ধারনা করা হয় প্রথম আবির্ভুত হয়েছিল প্রায় ৫৫০ মিলিয়ণ বছর আগে। চোয়ালহীল ক্রেনিয়েটরা উপস্থিত ছিল ক্যামব্রিয়ান পর্বে শুরুর দিকে প্রায় ৫২৫ থেকে ৫৩০ মিলিয়ন বছর আগে (৫৩০ মিলিয়ণ বছর তাদের সম্ভাব্য আবির্ভাব দেখানে হয়েছে); এখন যে বড় বিতর্কটি আছে তা হলো মিক্সিনিফরমেসরা ( যাদের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি হ্যাগফিস); চোয়ালসহ মেরুদন্ডীদের থেকে ল্যাম্প্রেরা আলাদা হবার আগে না পরে বিভক্ত হয়েছে, সেই বিষয়টি ( ছবি কালো আর গ্রে রং এর ডাশ লাইন দিয়ে দেখানো হয়েছে; অসংখ্য শ্রেনীর চোয়ালহীন মাছে এর পরে বিবর্তিত হয়েছে ৫০০ থেকে ৪৩০ মিলিয়ন বছর আগে, যে প্রজাতিগুলোর কোন প্রতিনিধি বর্তমানে জীবিত নেই। প্রথম চোয়ালবিশিষ্ট মেরুদন্ডী প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন বছর আগে, বর্তমানে এই শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করছে তরুনাস্থি বিশিষ্ট এবং অস্থি বিশিষ্ট মাছ, টেট্রাপোডরা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মেরুদন্ডী প্রাণীদের চোখের বিবর্তনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য পর্যায় জীবিত প্রধান প্রধান ট্যাক্সাগুলোর বিভক্তির অন্তবর্তীকালীন সময়ের সাথে সামন্জস্য রক্ষা করে। সুত্র: ট্রেভর ল্যাম্ব ও সহযোগীরা : Nature Reviews: neuroscience; volume 8, December 2007)
কম্পাউন্ড বনাম ক্যামেরাস্টাইল চোখ:
জীবাশ্ম রেকর্ড বলছে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরনের সময়েই দুটি মৌলিকভাবে ভিন্ন স্টাইলের চোখের উদ্ভব ঘটে। প্রথমটি ধারনা করা হয় কম্পাউন্ড ধরনের চোখ যা আমরা এখন সকল কীটপতঙ্গ,মাকড়শা এবং ক্রাষ্টাশিয়ান -অমেরুদন্ডী প্রানীদেরে একটি অংশ যাদের একসাথে আমরা বলি আর্থ্রোপড । এধরনের চোখে অনেকগুলো অনুরুপ ইমেজিং ইউনিট পাশাপাশি সাজানো থাকে, যাদের প্রত্যেকটির একটি করে লেন্স বা রিফ্লেক্টর থাকে যাদের কাজ হচ্ছে আলোকে ফোকাস করে ইউনিটের অল্প কিছু আলোকসংবেদী ফটোরিসেপটরের কাছে পৌছে দেয়। এধরনের কম্পাউন্ড বা যৌগিক চোখ ছোট আকারের প্রাণীদের জন্য খুবই উপযোগী, কারন এটা বেশ একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল দৃষ্টি দেয় এবং তাদের মোটামুটি ছোট আকারের একটি স্পাশিয়াল রেজুলেশন পাওয়া যায় । ক্যামব্রিয়ান সময়ে এধরনের দৃষ্টি ক্ষমতা হয়তো ট্রিলোবাইট বা প্রাচীন আর্থ্রোপডদের বেচে থাকার জন্য একটি উপযোগী অস্ত্র ছিল, তাদের দৃষ্টিহীণ সমসাময়িকদের তুলনায়। যৌগিক চোখ বড় প্রানীদের জন্য প্র্যাকটিক্যাল বা কার্য্যকরী নয়, কারন সেই অনুপাতে হাই রেজুলেশন দৃষ্টি তৈরী করতে গেলে যৌগিক চোখের আকৃতিও অনেক বড় হতে হবে, আর সেকারনেই শরীরের আকার বাড়ার সাথে সাথে,প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপও বেড়েছে অন্য রকম চোখের বিবর্তনের স্বপক্ষে: ক্যামেরা-স্টাইল চোখ।
ক্যামেরা স্টাইল চোখের সব ফটোরিসেপ্টররা একটি মাত্র আলো ফোকাসকারী লেন্সকে ভাগাভাগি করে নেয়। এবং চোখের দেয়ালের ভিতরের দিকটাকে আবরন করে এরা সজ্জিত থাকে চাদরের মত একটা স্তরে;যাকে বলা হয় রেটিনা। স্কুইড বা অক্টোপাসের কিন্ত ক্যামেরা-স্টাইল চোখ আছে , যা বাহ্যিকভাবে আমাদের মত দেখতে,তবে তাদের চোখের ফটোরিসেপ্টর কোষগুলো কীট-পতঙ্গদের চোখে যেমন ফটোরিসেপ্টর থাকে অনেকটা তার মত। মেরুদন্ডীপ্রানীদের ফটোরিসেপ্টরগুলো ভিন্ন ধরনের হয়,এদের মধ্যে যাদের জ বা চোয়াল আছে এমন মেরুদন্ডীদের (যেমনআমরা সহ)ক্ষেত্রেএই ফটোরিসেপ্টরদেখা যায় দুই ধরনের: দিনে আলোর জন্য কোনস (cones)ও রডস (rods), যা রাতের বেলায় অল্প আলোতে দেখার জন্য।
ছবি: রেটিনা: আমাদের চোখের পেছনে স্নায়ুকোষ, ফটোরিসেপ্টর ও নানা সহযোগী কোষের একটি স্তর। এটি আলোক সংকেতকে স্নায়ুসংকেতে রুপান্তরিত করে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে আমাদের ব্রেনে ভিজুয়াল ইনফরমেশন প্রেরণ করে, যা আমাদের দেখার অনুভুতি সৃষ্টি করে। রঙ্গীন কোন দৃশ্য দেখাটা নির্ভর করে কোন ( CONE) নামের একধরনের ফটোরিসেপ্টরের উপরে, যারা কোনের মতোই দেখতে এবং আলোক সংবেদী বিশেষ পিগমেন্ট বহন করে, যা আলোর সংস্পর্শে আসলে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য যে ফটোরিসেপ্টরগুলো আমাদের কম আলোয় (যেমন রাতে) দেখতে সাহায্য করে তাদের নাম রড (ROD); এই রড এবং কোন কোষগুলো রেটিনার একদম পেছনের স্তরে, অন্য অনেক সহযোগী কোষের পিছনে অবস্থান করে যারা সবাই আমাদের দৃষ্টি ক্ষমতার জন্য দায়ী। ANDREW SWIFT (retina illustrations); Scientific American.
বেশ কয়েক বছর আগে তিনজন বিজ্ঞানীর একটি টিম: পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এডওয়ার্ড এন পাগ (জুনিয়র),অষ্ট্রেলিয়ার কুইনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালেয়ে শন পি কলিন এবং ক্যানবেরার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেভর ডি ল্যাম্ব কেমন করেনানা ধরনেরএই ফটোরিসেপ্টরগুলোর বিবর্তনও রুপান্তর হয়েছে তার রহস্য উদঘাটনে গবেষনা শুরু করেন। তাদের গবেষনার ফলাফল ফটোরিসেপ্টরের বিবর্তনতো বটেই,মেরুদন্ডী প্রানীদের চোখের বিবর্তনের এর একটি সুস্পষ্ট ক্রমবিকাশ এর চিত্র গঠনেও সহায়তা করেছে।
সময়ের অনেক গভীরে প্রোথিত যে শিকড়:
ট্রেভর ল্যাম্ব ও তার সহযোগীদেরআগে কাজ করে যাওয়া জীববিজ্ঞানীদের মতই তারাওলক্ষ্য করেন, মেরুদন্ডী প্রানীদের চোখেদেখা যায় এমন কিছু গুরুত্বপুর্ণ সাধারনবৈশিষ্টগুলো,মেরুদন্ডী প্রাণীদের একটি প্রধান শাখা:চোয়ালযুক্তমেরুদন্ডী প্রানী’দের সকল জীবিত সদস্যদের মধ্যে একই রকম। বিজ্ঞানীরা আগেই ধারনা করেছিলেন, এই সাধারন প্যাটার্ণটা ইঙ্গিত করছে, যে চোয়ালযুক্তমেরুদন্ডী প্রাণীরা এই বৈশিষ্টটা বংশানুক্রমিকভাবে বা উত্তরাধিকার সুত্রেপেয়েছে, তাদেরএকটি কমন পুর্বপুরুষ থেকে। এবং আমাদের মত এই ক্যামেরা-স্টাইলচোখ প্রায় ৪২০ মিলিয়ন বছর আগে যখন প্রথম চোয়াল যুক্ত মেরুদন্ডী প্রানী(যা সম্ভবতঃ বর্তমান যুগের কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি যুক্ত কোন মাছযেমন হাঙ্গরের মত দেখতে ছিল)সাগরে ঘুরে বেড়াতততদিনে বিবর্তিত হয়ে গেছে। এ কারনে ট্রেভর ল্যাম্ব তার সহযোগীরা এখানে প্রস্তাব করেন যে,আমাদের ক্যামেরা স্টাইল চোখ এবং এর ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোর ইতিহাস ও উৎপত্তি নিশ্চয়ই আরো অতীতে বিস্তৃত;সুতরাং এদের আবির্ভাবের উৎস খুজতেআমাদের আরো অতীতে খুজতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে তারা চোখের উৎপত্তি খুজতে প্রথমে গবেষনার জন্য নজর দেনআরো প্রাচীন চোয়ালহীন মেরুদন্ডী প্রানীদের দিকে;আমাদের এবং যাদের একটি কমন আদিপ্রানী ছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের কাছাকাছি কোনেএকটা সময়ে।
প্রথমেই তারা এরকম কোন, এখনওজীবিতপ্রাণীর অ্যানাটোমি খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন, এভাবেই তারা তাদের গবেষনার প্রথম নজর দেন, এই গ্রুপের এখনও অস্তিত্ব আছেএমন একটি প্রাণীর দিকে: সেটি হচ্ছে ল্যাম্প্রে(Lamprey);ল্যাম্প্রে হচ্ছে ঈল মাছের মতএক ধরনের মাছ,যাদের মুখটা ফানেলের মতে যা আসলে কোন কিছু কামড় দেয়ার বদলে শুষে নেবার জন্য বেশী উপযোগী।গবেষনায়দেখা যায় এই মাছটিরও ক্যামেরা-স্টাইল চোখ আছে,যার লেন্স,আইরিস এবংচোখের সহযোগীমাংশপেশীওআছে। এমনকি ল্যাম্প্রের রেটিনাও তিন স্তর বিশিষ্ট আমাদের মতন,আমাদের চোখের)আলোকসংবেদী কোষ বা ফটোরিসেপ্টরকোন (Cone) এর সাথেও বেশ মিল আছে এদের ফটোরিসেপ্টরের। আমাদের মত যদিও ল্যাম্প্রেররেটিনায়আরো বেশী সংবেদীফটোরিসেপটররড(Rod) বিবর্তিত হয়নি। এছাড়া যে জীণগুলো আলো শনাক্ত করার নানা বিষয়গুলো,এর সাথে সংশ্লিষ্টস্নায়বিক প্রক্রিয়া আর চোখের বিকাশের সাথে জড়িত,সেই একই জীনগুলো চোয়ালযুক্ত মেরুদন্ডী প্রানীদের শরীরেরও ঠিকএকই কাজগুলোই করে।
ছবি: দক্ষিন গোলার্ধের ল্যাম্প্রে Geotria autralis ; a) লার্ভা অবস্থায় , Ammocoete b) পোষ্ট মেটামরফিক ‘downstream’ পুর্ণবয়স্ক ল্যাম্প্রে । লক্ষ্য করুন: লার্ভা অবস্থায় এদের মুখ আছে, সাতটি ফূলকা ছিদ্র আছে, কিন্তু এদের সারফেসে কোন চোখ নেই। কিন্তু তার বদলে এদের একটা অপরিনত চোখের মত অঙ্গ আছে যা চামড়ার গভীরে অবস্থান করে। এটি এবং আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে Ammocoete হ্যাগফিশের মত। (সুত্র: ট্রেভর ল্যাম্ব ও সহযোগীরা : Evolution: Education and Outreach (1: 2008))
চোয়ালযুক্ত মেরুদন্ডী প্রানীদের এদের চোখের এই বিশেষ সাদৃশ্যগুলো এতো বেশী যে, স্বতন্ত্রভাবে তাদের বিবর্তিত হবার বিপক্ষে স্বাক্ষ্য দেয়। বরং আমাদের মতই প্রায় একই রকম কোন চোখ অবশ্যই ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে চোয়ালহীণ আর চোয়ালসহ মেরুদন্ডীদের কমন আদিপ্রাণীতে বিদ্যমান ছিল। এই পর্যায়ে ট্রেভর ও তার সহযোগীরা ভাবতে বাধ্য হন, চোখ আর এরফটোরিসেপ্টরের উৎপত্তির ইতিহাসের সন্ধানে তারা আরো অতীতে যেতে পারেন কিনা? সেই লক্ষ্যেপরবর্তী যে সময়টা নিয়ে গবেষনা করা যৌক্তিক, সেই সময় কালটা ছিল ৫০০ মিলিয়ন বছরের আগের আরো ৫০ মিলিয়ন বছর; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে,যে লিনিয়েজটি আমাদের লাইন থেকে এর আগের(৫০০ মিলিয়ন বছরের) ৫০ মিলিয়ন বছর আগেআলাদা হয়েগেছে, সেই লিনিয়েজের প্রতিনিধিত্বকরতে পারে এমন কোন সদস্যবর্তমানে জীবিত নেই। কিন্তু ট্রেভর ল্যাম্বের টিমসেই রহস্যেটির সমাধানে কিছু গুরুত্বপুর্ন ক্লু বাধারনা খুজে পান আরেকটি রহস্যময় প্রানী থেকে,যার নাম হ্যাগফিশ (Hag fish)।
ছবি: হ্যাগফিশ এবং তাদের রেটিনা। a) নিউজিল্যান্ড হ্যাগফিশ Eptatretus cirrhatus b) এই প্রজাতির মাথার দিকের অংশ। a এবং b সুস্পষ্ট ভাবে স্বচ্ছ চামড়ার প্যাচটা দেখা যাচ্ছে, যার নীচে হ্যাগফিশের ’চোখ’ চামড়ার গভীরে অবস্থান করে। c) হ্যাগফিশের রেটিনা Eptatretus stouti , মাইক্রোস্কোপের নীচে ; OS : আউটার সেগমেন্ট RC: রিসেপ্টর কোষ, OFL: আউটার বা প্লেক্সিফর্ম লেয়ার, IC: ইনার সেল (রেটিনাল গ্যাঙ্গলিয়ন সেল), IFL : ইনার ফাইবার বা প্লেক্সিফর্ম লেয়ার V: ভিট্রিয়াস সুত্র: ট্রেভর ল্যাম্ব ও সহযোগীরা : Evolution: Education and Outreach (1: 2008)
তাদের খুব কাছের আত্মীয় ল্যাম্প্রের মতই,হ্যাগফিশঈল-মাছের মত দেখতে চোয়ালহীন মাছ। এরা মুলত: সাগরের তলদেশে বাস করে। যেখানে তারা সাগরের অন্য মৃত প্রানীদের দেহাবশেষআর ক্রাস্টাশিয়ান দের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। যখনইএরা আক্রান্ত হবারভয় পায়, তখন খু্বই পিচ্ছিল একটা ঘন একটি তরল এরা শরীর থেকে বের করে,সেজন্য এদের আরেক নাম আঠালো বা স্লাইমী ঈল।যদিও হ্যাগফিস মেরুদন্ডী প্রানী,তাদের চোখের সাথে মেরুদন্ডী প্রাণীদের চোখের গভীর পার্থক্য আছে। হ্যাগ ফিসের কোন কর্ণিয়া থাকে না,এছাড়া আইরিস,লেন্স কিংবা চোখের সহযোগী মাংশপেশীর কোনটাইনেই। মেরুদন্ডী প্রানীদের রেটিনার তিন স্তরের বদলেহ্যাগফিশের রেটিনায় আছেদুইটিস্তর। উপরন্তু তাদের চোখ স্বচ্ছ একটা চামড়ার প্যাচ বা স্পটের নীচে, চামড়ার গভীরেঅবস্থান করে। হ্যাগফিসের আচরণ পর্যবেক্ষন করলেবোঝা যায়,এরা মুলত: চোখে দেখে নাবা বলা যায় ভার্চুয়ালী ব্লাইন্ড। এদের অন্যতম খাদ্যের উৎস সামদ্রিক প্রানীদের মৃতদেহএরাখুজে পায় এদের শক্তিশালী গন্ধশোকার ক্ষমতার মাধ্যমে।
হ্যাগফিস আর ল্যাম্প্রেদের বিভাজিত হয়েছে একটি কমন আদি প্রানী আছে। এবং সম্ভবতঃ এই আদি প্রাণীদেরওল্যামেপ্রির মতো ক্যামেরা স্টাইল চোখ ছিল। সুতরাং হ্যাগফিসের চোখের নিশ্চয়ই আরো উন্নত রুপথেকে ক্রমাবনতি ঘটেছেএই রুপে।এবং এটি যেএখনও টিকে আছে,এরকমএকটি ডিজেনেরেট বা অপজাত রুপ নিয়েসেই বিষয়টা এর রপান্তর সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপুর্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে।যেমন, আমরা ব্লাইন্ড কেভফিসের গবেষনা থেকে দেখেছি,চোখ একটিব্যাপক ডিজেনেরেশন পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারেএমনকি মাত্র ১০,০০০ বছরের মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে,যেমনটি ঘটেছে ব্লাইন্ড কেভ ফিসের ক্ষেত্রে। কিন্ত হ্যাগফিশের চোখ একই রকম অপরিবর্তিত অবস্থায়আছে কয়েকশ মিলিয়ন বছর। এর স্থায়িত্ব ইঙ্গিত করছেযে, সাগরে নীচে প্রায় অন্ধকার পরিবেশেযদি হ্যাগফিশতার এইচোখগুলো দেখার কাজে ব্যবহারই না করতে পারে,তাহলে নিশ্চয়ই এর অন্য কোন কাজ আছে, যা কিনা কোন না কোন ভাবে হ্যাগফিশের বেচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়। এই আবিষ্কারটি এছাড়াও আরোনতুন কিছু ধারনাও দেয়। হ্যাগফিশের চোখ হয়তো পরিপুর্ণ বিকাশ হবার পথেরকোন একটি পর্যায়েথেমে গিয়েএধরনের আদিম স্তরের প্রাথমিক বা রুডিমেন্টারী পর্যায়ের রুপেরয়ে গেছে; সেকারনেই হয়তো এর বর্তমান গঠনবা আর্কিটেকচার আদি বিবর্তন কোন একটিপর্যায়ের গঠনকেইপ্রতিনিধিত্ব করছে। সেকারনেই হ্যাগফিশের চোখের কর্মপদ্ধতি ট্রেভর ল্যাম্ব ও তার সহযোগীদেরবুঝতে সাহায্য করেসম্পুর্ন ভিজ্যুয়াল বা দৃষ্টি ক্ষমতা সম্পন্ন চোখে বিবর্তিত হবার আগেকেমন করে প্রোটো-আই বা আদি-চোখ কাজ করে ।
হ্যাগফিসের রেটিনা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করলে হ্যাগ ফিসের চোখ কি ভূমিকা পালন করে তার একটা ধারনা পাওয়া যায়। মেরুদন্ডী প্রানীদের স্ট্যান্ডার্ড ত্রি স্তর বিশিষ্ট রেটিনায় মাঝের স্তরে থাকে বাইপোলার কোষ, যারা ফটোরিসেপ্টর থেকে তথ্য নিয়ে প্রসেস করে আউটপুট নিউরন বা স্নায়ুকোষে পৌছে দেয়; যেখান থেকে স্নায়বিক সংকেত অপটিক নার্ভ দিয়ে ব্রেণে পৌছায় এবং ব্রেনের ভিজুয়াল কর্টেক্স প্রথমে প্রাপ্ত সংকেতগুলো বা তথ্যগুলো ইন্টারপ্রিট বা ব্যাখা করে; এ ক্ষেত্রে আমরা দৃশ্যটি দেখার অনুভব বোধ করি। হ্যাগফিশের দ্বিস্তর বিশিষ্ট রেটিনায়, মাঝের এই বাইপোলার কোষের স্তরটি থাকেনা, যার মানে ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোর প্রসেস গুলো সরাসরি সংযুক্ত থাকে আইটপুট নিউরোনের সাথে। এই অর্থে হ্যাগফিশের রেটিনা স্নায়ু সংযোগ সার্কিটটি পিনিয়াল গ্রন্হির মতো। পিনিয়াল গ্রন্হি মেরুদন্ডী প্রাণীদের ব্রেনে অবস্থিত খুব ক্ষুদ্র হরমোন তৈরীর একটি গ্রন্হি, এটি শরীরের সারকাডিয়ান বা দৈনন্দিন রিদমকে (আভ্যান্তরিন ঘড়ি) বা ছন্দকে নিয়ন্ত্রন করে। স্তন্যপায়ী নয় এমন মেরুদন্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে পিনিয়াল গ্রন্থিতে যে ফটোরিসেপ্টর কোষ থাকে, সেটি সরাসরি আইটপুট নিউরোনের সাথে সংযোগ করে মধ্যবর্তী কোন কোষের স্তর ছাড়াই। স্তন্যপায়ী প্রানীদের ক্ষেত্রে গ্রন্থিটি তার সরাসরি আলো শনাক্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের সাথে এধরনের সাদৃশ্য পর্যবেক্ষন করে ট্রেভর ডি ল্যাম্ব ও তার সহযোগীরা ২০০৭ সালে প্রস্তাব করেছিলেস, হ্যাগফিশের চোখ কোন দেখার কাজে ব্যাবহৃত হয়না কিন্তু এটি হ্যাগফিশের ব্রেনে এমন কিছু ইনপুট সিগন্যাল পাঠায় যার তাদের শরীরের গুরুত্বপুর্ন সারকাডিয়ান রিদমকে নিয়ন্ত্রন করে, এছাড়া সিজনাল বা ঋতু নির্ভর কিছু কাজ, যেমন খাওয়া, প্রজনন ইত্যাদিও সম্ভবত নিয়ন্ত্রন করে। সম্ভবত সেক্ষেত্রে আদি মেরুদন্ডী প্রানীরা যারা ৫৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে জীবিত ছিল, তাদের এই আদি চোখ প্রথমে উ্দ্ভব হয়েছে দেখার জন্য নয়, বরং দৃষ্টিক্ষমতাহীন অঙ্গ হিসাবে এবং শুধু পরবর্তীতে বিবর্তিত হয় এর স্নায়ু নির্ভর প্রসেসিং, অপটিক্যাল এবং মটোর ( যেমন মাংশপেশী) অংশগুলো, যা দৃষ্টি ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন।
মেরুদন্ডী প্রাণীদের ভ্রুণতাত্ত্বিক বিকাশ সংক্রান্ত গবেষনা পরবর্তীতে তাদের এই ধারনার স্বপক্ষে প্রমানও যোগান দিয়েছে। যখন ল্যাম্প্রে তার লার্ভা স্তরে থাকে, এটি তখন স্ট্রিম বেডে বসবাস করে এবং হ্যাগফিসের মতই চোখে কিছু দেখতে পারেনা। এই সময় তাদের চোখও হ্যাগ ফিসের চোখের অনুরুপ, সাধারন সরল গঠন বিশিষ্ট ও চামড়ার নীচে ঢোকানো। লার্ভা যখন রুপান্তরিত হতে থাকে এর সেই অবিকশিত চোখও আকারে বড় হয়, এবং এর তিন স্তর বিশিষ্ট রেটিনা, লেন্স, কর্নিয়া এবং সহযোগী মাংশপেশীগুলো তৈরী হয়। এরপর এটি ক্যামেরা স্টাইল চোখে হিসাবে চামড়ার নীচ থেকে বের হয়ে আসে। যেহেতু কোন প্রাণীর বিকাশের নানা বৈশিষ্ট তার পুর্বপুরুষ আদি প্রানীর বিবর্তনের সময়কার ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনেরই প্রতিফলন ঘটায়, সেহেতু আমরা খানিকটা সতর্কতার সা্থে, ল্যাম্প্রের চোখের বিকাশ ও পরিবর্তন পর্যবেক্ষন করে, সেই তথ্যগুলোর সহায়তায় কেমন করে বিবর্তিত হয়েছে চোখ, সেই পর্যায়গুলো বিজ্ঞানীদের পক্ষে পুননির্মান করা সম্ভব।
স্তন্যপায়ী প্রানীদের ভ্রুণতাত্ত্বিক বিকাশের সময়, তাদের চোখও সুস্পষ্টভাবে তাদের বিবির্তনীয় উৎপত্তির বৈশিষ্ট প্রকাশ করে। সান্তা বারবারার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় গবেষক বেনজামিন ই. রীস ও তার সহযোগীরা প্রমান করেছেন যে স্তন্যপায়ীদের রেটিনা স্নায়ু সার্কিটট্রিটি শুরু হয় অনেকটাই হ্যাগফিশের যেমন আছে, সেভাবে; প্রথমে ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোর প্রসেসগুলো সরাসরি আইটপুট নিউরোনের সাথে সংযুক্ত থাকে। তারপর, পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাইপোলার কোষগুলো পূর্ণতা পায় এবং ফটোরিসেপ্টর আর আউটপুট নিউরণকে সংযোগ করে মধ্যবর্তী একটি স্তর তৈরী করে। বিজ্ঞানীদের মতে ঠিক এই ধরনেরই রুপান্তরের পর্যায়ক্রমটাই দেখার কথা ছিল, যদি আমরা আশা করি যে, দুই স্তর বিশিষ্ট সারকাডিয়ার রিদম নিয়ন্ত্রনকারী কোন এটি অঙ্গে , স্নায়ু নির্ভর প্রসেসিং এবং দৃশ্য তৈরীর নানা উপাঙ্গ যুক্ত হয়েই মেরুদন্ডী প্রানীর ত্রি স্তর বিশিষ্ট মেরুদন্ডী প্রানীদের রেটিনা বিবর্তিত হয়। সে কারনেই এটা পুরোপুরি সম্ভব মনে করা হচ্ছে যে, রেটিনার বাইপোলার সার্কিটের আবির্ভাব এবং লেন্স, কর্নিয়া এবং সহযোগী মাংশপেশী আবিষ্কারের পূর্বে এই প্রাথমিক, সহজ ধাপটি আসলে বিবর্তন প্রক্রিয়ারই একটি হোল্ডওভার ( অর্থাৎ যা আগে থেকেই ছিল) পর্বকে প্রতিনিধিত্ব করে।
ছবি: বিবর্তনের প্রতিধ্বণি: হ্যাগফিশ এবং ল্যাম্প্রের ( আদিম গঠনের ঈল–সদৃশ মেরুদন্ডী প্রানী) চোখের গঠন এবং ভ্রণতাত্ত্বিক বিকাশ ইঙ্গিত দেয় কেমন করে আমাদের ক্যামেরা–স্টাইল চোখ বিবর্তিত হয়েছে এবং এর প্রথম দিকের ধাপগুলো এটি কিভাবে কাজ করতো। প্রাপ্তবয়স্ক হ্যাগফিসের চোখ ডিজেনেরেট বা অপজাত হয়ে যায়, যা দিয়ে সে আর কোন কিছু দেখতে পায়না, তবে সম্ভবত তার শারীরিক সারকাডিয়ান (দৈনন্দিন) রিদমকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য এই অপজাত চোখটি আলো শনাক্ত করতে সক্ষম (১); ভ্রুনাবস্থায় প্রথম দিকে ল্যাম্প্রের চোখ দেখতে অনেকটা সহজ গঠনের হ্যাগফিশের চোখের মতই, পরবর্তীতে যা রুপান্তরিত হয় গঠনগতভাবে জটিল ক্যামেরা স্টাইল চোখে (২); মানুষের চোখও ভ্রুণাবস্থায় একপর্যায়ে হ্যাগ ফিসের চোখের মত পর্যায় অতিক্রম করে, যখন আমাদের রেটিনা তিনটি স্তরের হবার আগে দুটি স্তর বিশিষ্ট থাকে (৩); সাধারনতঃ কোন প্রাণীর ভ্রুণতাত্ত্বিক বিকাশের সময় পরিলক্ষিত নানা বৈশিষ্ট তার লিনিয়েজের বিবর্তনের সময় ঘটা নানা পর্যায়গুলোকেই প্রতিফলন করে। আজ পযন্ত্য পাওয়া সকল প্রমান ইঙ্গিত করে, দৃষ্টিক্ষমতাহীন দ্বিস্তর বিশিষ্ট রেটিনা বিশিষ্ট একটি প্রোটো–আই বা আদি চোখ প্রায় ৫৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে মেরুদন্ডী প্রানীদের আদি পুরুষদের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছিল (৪); যে প্রোটো–আইটি ক্যামেরা স্টাইল চোখের আদিরুপ সেই প্রোটো–আই আমাদের পুর্বপুরুষ প্রানীদের শরীরের আভ্যান্তরীন শারীরবৃত্তীয় ছন্দ ( সারকাডিয়ান রিদম) বা ইন্টারনাল ঘড়িকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলো শণাক্ত করতো। (সুত্র: Illustration by Jen Christiansen /Scientific American)
চলবে…..
ধন্যবাদ
অনেক কিছু জানলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ