জলাঙ্গির কুমোর পাড়ার জয়শ্রী
অনেক খুঁজে অনেক হেঁটে অবশেষে পৌঁছলাম নদীয়ার জলাঙ্গি গ্রামে। এটা একদম গঙ্গার গাঁ ঘেষে জলমগ্ন গাঁ। ট্রেন থেকে নেমে, গ্রাম্য রিক্সা ভ্যানে কিছুটা গিয়ে, তারপর গঙ্গার তীরঘেষে ঘন্টাখানেক হেঁটে পৌছলাম জলাঙ্গির কুমোর বাড়ি। এ ঠিকানাটা অনেক কষ্টে, অনেক শ্রমে জোগার করেছি প্রায় ২-বছরের চেষ্টায়। তাই বাড়ির কাছাকাছি এসে দুপুরে হাঁটার ক্লান্তিটা ঝাড়তে গঙ্গার হাটু জলে নেমে জল দেই চোখেমুখে। একটু ফ্রেস হয়ে ঢুকি অপরিচিত এ বাড়ির ভেতরে। ঢুকতেই পথে বেশ কজন অল্পবয়সি ছেলেমেয়েকে দেখি মাটির হাড়ি-পাতিল শুকোনোর কাজে ব্যস্ত। একটা খোলা ছাউনি দেয়া মাটির ঘরে কাজ করছিল মাঝবয়েসি এক পুরুষ। সে চাকা ঘুরিয়ে তৈরি করছিলো কাঁচা মাটির জিনিসপত্র। তার পাশেই দাঁড়িতে জানতে চাইলাম – “দাদা জয়শ্রী কি এ বাড়িতে থাকে? বাংলাদেশের শশধর কুমোরের কন্যা জয়শ্রী, যার প্রায় কুড়ি-বছর আগে বিয়ে হয়েছিল এ বাড়িতে”। লোকটি হাত দিয়ে ঘুর্ণায়মান কুমোরের চাকা থামিয়ে বললো – “বলুন কি দরকার তাকে? আমার দাদার স্ত্রী জয়শ্রী। আপনি কোত্থেকে এসেছেন”?
:
দুপুরের তপ্ত রোদে হেঁটে আসার সব ক্লান্তি উড়ে গেল আমার পলকেই। মুখে হাসি নিয়ে বললাম – “বাংলাদেশ থেকে এসেছি দাদা। আপনার দাদার শ্বশুর বাড়ির লোক আমি। ডাকবেন জয়শ্রীদিকে একটু। কথা শুনে ভেতর থেকেই শব্দ করে জানতে চাইলো – “কে গো আমার কথা জানতে চাইছে”? সামান্য নেংটি জাতিয় ধূতি পরা খালি গায়ের ভাসুর জগদীশ বললো – “দেখতো বাংলাদেশের তোমার বাবার বাড়ি থেকে কে যেন এসেছে”।
:
বাক্য শেষ না হতেই একঝাঁক আনন্দবন্যার মত দৌঁড়ে এলো জয়শ্রী একদম আমার সামনে। আমি বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকলাম প্রায় কুড়ি বছর আগে দেখা জয়শ্রীর দিকে। হ্যা আমার দ্বীপগাঁয়ের প্রতিবেশি একমাত্র কুমোরপাড়ার সেই শ্যামলা মেয়েটি জয়শ্রী, যার কাছে স্কুল পালিয়ে প্রায়ই আমি বসে থাকতাম কুমোর হওয়ার বাসনায়। কিশোর জয়শ্রীর বাবা সুন্দর অনুপম নিখুঁত নিপুণতায় যখন বানাতো মাটির ঘড়া, বাসন কিংবা দেবমূর্তি, তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম আমি। পৃথিবীর সব বিদ্যার চেয়ে কুমোরবিদ্যা শ্রেষ্ঠতর মনে হতো আমার চোখে। অনেকদিন ঘরের ডাব, পেয়ারা কিংবা মোয়া জয়শ্রীকে ঘুষ দিয়ে বলতাম – “বলনা জয়শ্রী, তোর বাবাকে কুমোর বানাতে আমায়”। ঘুষের মর্যাদা রেখেছিল জয়শ্রী। তাই বাবাকে অনেক অনুরোধ করেছিল আমার সামনে এবং গোপনে দু-ভাবেই। সত্যি শশধর কাকা একবার কুমোরের চাকতিটি আমার হাতে দিয়ে বলেছিলো – “বাবা এ কাজতো তোমাদের মত উঁচু মুসলমানদের নয়। আমরা নিচু জাতের গরিব হিন্দুরা করি কুমোর, কামার, নাপিত আর জেলের কাজ। তোমার বাবা জানতে পারলে আস্ত রাখবে না আমায়। কুমোর হওয়ার চিন্তা বাদ দাও বাবা। আমাকে বিপদে ফেলোনা”!
:
নাছোরবান্দা আমি তারপরো নিয়মিত যেতাম জয়শ্রীদের কুমোর বাড়ি। দাঁড়িয়ে দেখতাম নরম মাটি দিয়ে চমকপ্রদ নিপুণতায় নানাবিধ জিনিসপত্র বানানো, তা শুকানো আর পোড়ানোর দৃশ্য। অনেক সময় জয়শ্রীর সাথে হাত লাগাতাম তার হাড়ি-পাতিল রোদে দিতে কিংবা পোড়ানোর চুল্লীতে তুলতে। একবার আমার কৈশোরিক প্রেমিকা হিন্দু সুমি জলদাসের সাথে কথা হয়েছিল জয়শ্রীর। জয়শ্রী সুমি আর আমি প্রায় একই বয়সি ছিলাম। তবে সুমি আর আমি স্কুলে যেতাম কিন্তু জয়শ্রী কেবল কুমোরের কাজ করতো। এক বৈশাখি মেলায় জয়শ্রী বলেছিল সুমিকে, “আমি নাকি জয়শ্রীর প্রেমে পড়েছি, তাই নিজের জাতধর্ম ত্যাগ করে কুমোর পর্যন্ত হতে চাই”। এ নিয়ে সুমি বিবাদ লাগিয়েছিল আমার সাথে। কিন্তু জয়শ্রীর প্রতি জৈবিক টান ছিলোনা আমার কোনদিন। তবে কুমোরের কাজ, তাদের বাড়ি আর চালচলন সব ভাল লাগতো আমার। এটা শোনার পর থেকে জয়শ্রীদের বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম আমি।
:
বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে সরকারি চাকুরিতে ঢোকার প্রাকমূহূর্তে একবার দ্বীপগাঁয়ে গিয়ে শুনি, কুমোর বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান। তাতে আমাদের বাড়ির সবার নিমন্ত্রণ। মা জানালো, জয়শ্রীর বিয়ে হচ্ছে কোলকাতার এক ছেলের সাথে। এই ৩-দিন থেকেই কুমোর পাড়াতে তারই উৎসব। হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে গেলাম জয়শ্রীদের কুমোর বাড়িতে। ওর বাবা দেখে খুব সমাদর করে বসতে দিলো কোলকাতার অতিথিদের সাথে আমায়। তাদের সাথে আলাপ করছিলাম, এমন সময় ভেতর থেকে খবর এলো জয়শ্রীর মা ডাকছে আমায় ভেতরে। ঢুকতেই কেঁদে জয়শ্রী বললো – “দাদা ক্ষমা করে দিও আমায়। চলে যাচ্ছি আমি কোলকাতা। আমি মনে করেছিলাম, তুমি আমার জন্যে কুমোর হতে চেয়েছিলে। মাও আমাকে এমনটাই বলতো। তাই বুঝতে পারিনি কেবল মাটির বাসনের টানে তুমি আমাদের বাড়ি আসতে, আমার টানে নয়”। এ বিয়ের লগ্নে আমি আর বলতে পারিনি জয়শ্রীকে যে, “তোর জন্যই কুমোর হতে চেয়েছিলাম আমি রে জয়শ্রী”!
:
চুলে পাক ধরা রঙজ্বলা ক্ষয়িষ্ণু জয়শ্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম – “জয়শ্রী তুমি কি আমায় চিনতে পারছো? আমার নাম শাহ আলম তোমার প্রতিবেশি ছিলাম। কুমোর হওয়ার খুব সখ ছিলো আমার কৈশোরে, মনে নেই তা তোমার জয়শ্রী”? আকাশভাঙা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে জয়শ্রী বললো – “দাদা আপনি! কিভাবে চিনলেন এ বাড়ি? এতোদুর কিভাবে এলেন? সত্যিই আপনি? বিশ্বাসই হচ্ছেনা আমার”! ছেলেমেয়ে সবাইকে ডাক দিলেন একসাথে, যেন আনন্দের সংবাদের পরিবর্তে কোন ভীষণ বিপদ। ৪-ছেলেমেয়ে ছুটে এলো হাতের হাড়ি-পাতিল ফেলে। জয়শ্রী সবাইকে বললো – “আমার দাদা, তাকে প্রণাম কর তোরা”। সবাই প্রণাম করলো আমায় নিজ মামা মনে করে।
:
সারাবেলা রইলাম জয়শ্রীর বাড়ি। ওর হাতের রান্না খেলাম কুমোর বাড়িতে বহুদিন পর। ওর সন্তানদের শোনালাম আমার গাঁয়ের ফুরিয়ে যাওয়া শেষ বিকেলের গল্প। জয়শ্রী জানতে চাইলো, তার জ্ঞাতি আর পুরণো কুমোর বাড়ির অতীত কথামালা। এ কুড়ি বছরে আর যেতে পারেনি সে, তার মায়ের বাড়ি। কেবল শুনেছে তারা মারা গেছে দুজনে অনেক আগেই। কি বিচিত্র জীবন মানুষের। বিয়ের কারণে মেয়েরা কত সহজভাবে ভুলে যায় নিজ বাড়ি, মা বাবা প্রতিবেশি স্বজন সবাইকে।
:
সন্ধ্যার ট্রেনে কোলকাতা ফিরতে বিদায় চাইলাম জয়শ্রীর কাছে। টিনএজ ভাললাগা বাতাসের পুরণো কলতানের গন্ধে মুখর মঞ্জুরী এনে জয়শ্রী বললো – “কুমোর হতে ইচ্ছে করেনা এখন আর? কুমোর হয়ে থেকে যাওনা আমার কাছে”! অমিত্রাক্ষর জীবনের অপ্রাপ্তির দু:খরা দ্রোহ করে একসাথে বলে এবার – “তখন বানালে না কেন? এখন কি কুমোর হওয়ার বয়স আর ইচ্ছে আছে আমার”? বিদায়ক্ষণে ছেলেমেয়ের সামনেই জলভরা চোখে জয়শ্রী হাত ধরে আমার। কাঁপাকণ্ঠে বলে – “কেন কুমোর হলেনা তুমি? তাহলেতো এ পরবাসে এসে এতো অল্পবয়সে বিধবা হতে হতোনা আমায়”! জয়শ্রীর কথার কোন জবাব দিতে পারিনা আমি। জীবনের বর্ণিল খামেভরা স্বর্ণালী সময়ের চিঠিপত্রময় স্মৃতির ধুসরতায় নদীয়ার জলাঙ্গি গ্রামের গঙ্গা-তীরের কাঁচা সড়তে হাঁটতে থাকি আমি একাকি প্রাকসন্ধ্যায়। কিশোর জয়শ্রীর ভাললাগাময় নারীর তৎসম সন্ধি-সমাস খুঁজে খুঁজে হ্যাঁ হাঁটতে থাকি আমি জলাঙ্গির পথে ধরে। এ কাঁচা সড়কের বাঁকে-বাঁকে কাব্যিক স্বপ্নঘ্রাণের সপ্তপদি জ্যামিতিক সৌষ্ঠবে সারা পথে দাঁড়িয়ে থাকে চৌদ্দ বছরের জয়শ্রী পথ আগলে আমার। তাকে ঠেলে অযুত দিনের নিযুতসম কষ্টঋণের এ পথ ভেঙে এগুতে পারিনা আমি একটুও!
সাম্প্রতিক মন্তব্য