ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও সমাজ!
অনেকে মনে করেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের পরে পাশ্চাত্য দর্শনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও মৌলিক দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। তিনি জার্মান আইডিয়ালিজমের প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তির বাইরে তিনি একচুলও নড়তে চাইতেন না। মুক্তচিন্তা বলতে এ
কালে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তার চেয়েও বেশি যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার প্রবক্তা। তাঁর জীবন ছিল কঠোর নিয়মে বন্দী। সারা দিনের পাঁচটি মিনিটও তিনি অপচয় করতেন না। কখন ঘুম থেকে উঠবেন, চা খাবেন, লেখার টেবিলে বসবেন, লাঞ্চ করবেন, কয় মিনিট চোখ বুজে বিশ্রাম করবেন এবং কখন অপরাহ্ণে হাঁটতে বেরোবেন—সবই ছিল তাঁর কঠোর নিয়মে বাঁধা। তাঁকে রাস্তায় বেরোতে দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের ঘড়ির কাঁটা ঠিক করে নিতেন।
চিরকুমার কান্টের কাজের লোকটির নাম ছিল ল্যাম্বে। দিনরাত সারাক্ষণ তিনি দার্শনিকের বাড়িতে থাকতেন। কান্টকে জ্ঞানচর্চার অবকাশ দিয়ে ঘরদোরের সব কাজ—রান্নাবান্না, কাপড় ধোপাবাড়িতে দেওয়া প্রভৃতি—ল্যাম্বে করতেন। কয়েক দশক তিনি কান্টের বাড়িতে ছিলেন। তিনি ছিলেন দার্শনিকের অতি বিশ্বাসভাজন। কান্ট সারা দিনে পাঁচ-দশটি বাক্যের বেশি বলতেন না। তিনি যখন লিখতেন তখন ল্যাম্বে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতেন কখনো কখনো। কান্ট আপন মনে লেখালেখি করতেন। একদিন তিনি অনুভব করেন পেছনে দাঁড়িয়ে ল্যাম্বে কেমন অস্বাভাবিক জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পেছনে তাকিয়ে দেখেন ল্যাম্বের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে।
কান্টের মধ্যে আবেগের লেশমাত্র ছিল না। কাঁদার প্রয়োজন হলে কেউ কাঁদবে তাতে বিস্ময়ের কী? কান্ট জিজ্ঞেস করেন, তুমি এখানে কাঁদছ? কান্ট অপ্রয়োজনীয় বাক্য ব্যয়ের পাত্র ছিলেন না। আমরা হলে বলতাম, এখানে কান্নাকাটি কী? কাঁদো তো নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদো। কান্টের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ল্যাম্বে বললেন, আমি আপনার লেখা পড়ে কাঁদছি। কান্ট অবাক হন। ল্যাম্বে বলেন, গড আছেন কি
নেই, সে সম্পর্কে আপনি লিখছেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ-ট্রমাণ নিয়ে কী সব লিখছেন, আমি তা মানতে পারি না। গডের বিরুদ্ধে কোনো কথা আমার সইবে না।
মহাজ্ঞানী কান্ট ভেবে দেখলেন, ওর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে ওর অনুভূতিরও মূল্য রয়েছে। থাকুক ল্যাম্বে ওর বিশ্বাস নিয়ে। দুই দিন পর এক সকালে কান্ট দেখেন ল্যাম্বে সুটকেস গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে বাইবেলপরিপন্থী লেখায় তাঁদের ৩০-৪০ বছরের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। সুটকেস হাতে নিয়ে ল্যাম্বে চিরদিনের জন্য কান্টের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
বহু বছর আগে বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির অধীন গেলফার্টস্ট্রাসেতে ইনস্টিটিউট ফর ফিলোসফির এক আলোচনায় কান্টের জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে শোনার সুযোগ হয়েছিল। আঠারো শতকের শেষ দশকে, যখন গির্জার প্রভাব রাষ্ট্রের ওপর প্রবল, প্রকাশিত হয় কান্টের ‘রিলিজিয়ন উইদিন দ্য লিমিটস অব রিজন অ্যালোন’ শীর্ষক সন্দর্ভ। শুধু যুক্তির সীমার মধ্যে ধর্ম। খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়ামের কাছে নালিশ জানান। তখন কান্ট ইউরোপের দর্শনের ভুবনে সম্রাট। সম্রাট ফ্রেডরিকের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়ে কান্টকে এক কড়া চিঠি দেয় এই মর্মে যে ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলা বা লেখালেখি চলবে না। তাঁর ওই রচনা একটি অফেন্স বা অপরাধ এবং তা হাইয়েস্ট ডিসপ্লেজার বা সর্বোচ্চ অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। ঝামেলায় জড়িয়ে জ্ঞানচর্চায় ব্যাঘাত ঘটুক, তা যেমন চাইতেন না, তেমনি শেষ বয়সে গর্দানটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হোক, তাও তাঁর একেবারেই কাম্য ছিল না। সম্রাটের নির্দেশের লিখিত জবাবে কান্ট জানান: আপনার একজন অনুগত নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতে আমি আমার কোনো বক্তৃতায় বা রচনায়—অন রিলিজিয়াস ম্যাটার্স—ধর্মীয় বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এরপর ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, ধর্মের ধারেকাছেও যাননি কান্ট। তবে বলেছেন, এই যে নক্ষত্রখচিত রাতের মহাকাশ, এর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই রয়েছে মহারহস্য—কোনো এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তিকে যে নামেই ডাকা হোক।
কুড়ি শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী যৌক্তিক বিশ্লেষণী দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন বই লিখেছেন মাত্র একখানা: ট্র্যাকটেটাস, কিন্তু তাতেই তিনি কিস্তিমাত করেছেন। ওতে দাঁত বসানোর সাধ্য খুব কম দার্শনিক বিজ্ঞানীরই আছে। ভিটগেনস্টাইনকে বিজ্ঞানের দার্শনিকও বলা হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনিও বলেছেন: বিজ্ঞানের প্রধান রহস্যগুলোর সমাধান হয়ে যাওয়ার পরেও মানবজীবনের কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে।
কপারনিকাস হোন, গ্যালিলিও হোন, কেপলার হোন, নিউটন বা আইনস্টাইন হোন—পশ্চিমের পদার্থবিজ্ঞানীরা কেউ ধর্মবিরূপ ছিলেন না। তাঁরা মহাজগতের বস্তুর রহস্য ও সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁদের আবিষ্কারের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের বেমিল হয়েছে, কিন্তু তাঁরা নিজেদের আবিষ্কৃত তথ্যের কথাই বলেছেন, ধর্মগ্রন্থের বাণীর সঙ্গে কোথায় তার বিরোধ, তা নিয়ে বাহাস করেননি। ধর্ম প্রবর্তকদের তাঁরা খাটো করেননি। আইনস্টাইন এতটাই ধর্মভাবাপন্ন ছিলেন যে তিনি বড় হাতের ইংরেজি অক্ষর ‘G’ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখতেন। কারণ, গড লিখতে হয় ক্যাপিটাল জি অক্ষর দিয়ে।
ধর্ম আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এক জিনিস নয়। প্রাচ্যের অনগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোর বদনাম বেশি। অথচ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা পশ্চিমের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে কিছু ঘটলে তা নিয়ে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম আকাশ-বাতাস মাতিয়ে তোলে। তাদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কথা, খ্রিষ্টান মৌলবাদীদের কথা ধামাচাপা দেয়। বাংলাদেশের বা ভারতের কোনো মুসলমান পাঁচজন হিন্দুকে অথবা কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ পাঁচজন মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করলে তা তিন মাস ধরে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম প্রচার করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ। ২০১১ সালের ২২ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্য সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী হত্যাকাণ্ড ঘটে নরওয়েতে। আন্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক নামক এক খ্রিষ্টান মৌলবাদী একটি সামার ক্যাম্পের ৪১ জন যুবক-যুবতীকে বোমা মেরে ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি করে হত্যা করে। সে অতি সুস্থ এবং স্বীকার করে যে এশিয়ার কালোদের বিশেষ করে মুসলমান অভিবাসী নীতির বিরুদ্ধেই তার হত্যা অভিযান। ইউরোপ খ্রিষ্টানদের জন্য—হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধদের জন্য নয়। তার দেশের অতি প্রগতিশীল সরকার তাকে ‘পাগলাটে’ বা ‘অপ্রকৃতিস্থ’ বলে প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত বিচারের এজলাসে তাঁকে দাঁড় করিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ওই খ্রিষ্টান মৌলবাদী ও বর্ণবাদীকে ‘সাইকোটিক প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিক’ বলে হত্যাকাণ্ডটিকে হালকাভাবে দেখা হয়।
ইউরোপে একটি ভালো গণতান্ত্রিক সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে সন্দেহ নেই, আমরা তা করতে পারিনি বা করতে চাইনি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে। কিন্তু সেখানে যে বর্ণবাদী চেতনা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, তা দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের চেয়ে অনেক গভীরে। উদার মানবতাবাদের কথা তাঁরা বলেন এবং তা প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যমও তাঁদের আছে; কিন্তু তাঁরা জানেন না প্রাচ্যের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান মানবতাবাদীদের কথা। আমাদের মহামানবেরা সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাঁদের নিজেদের জীবনাচরণে, তা পশ্চিমে বিরল। আমাদের দুর্বলতা আমরা অন্যের মুখে ঝাল খাই এবং পোঁ ধরতে পছন্দ করি।
ধর্ম যদি মানব প্রগতির বাধা হতো, তাহলে আজ বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি হতো না। পাঁচ-ছয় শ মানুষ ও হাজার হাজার কিলোগ্রাম মালপত্র নিয়ে বিমান আকাশে উড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেত না। মানুষ চলাফেরা করত নৌকা বা ঠেলাগাড়িতে। চাঁদে বা মহাকাশে মানুষকে যেতে বাধা দেওয়া হতো। ধর্ম মহত্তম সভ্যতা সৃষ্টিতে কোনো অঞ্চলে কোনো কালেই কিছুমাত্র বাধা হয়নি। তা-ই যদি হতো, তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশে মহান বৈদিক হিন্দু সভ্যতা বা বৌদ্ধ সভ্যতা আমরা পেতাম না। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে স্পেন পর্যন্ত মহান ইসলামি সভ্যতা গড়ে উঠত না প্রাক-মধ্যযুগে। বৌদ্ধধর্ম অধ্যুষিত চীন, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। সব ধর্মাবলম্বীর ভেতরেই কিছু মানুষের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নোংরামি আগেও ছিল, এখনো আছে। স্রোতস্বিনী নদীতে মানুষ ও পশুর মৃতদেহ ভেসে যায়, তাতে নদীর পানি নষ্ট হয়ে যায় না। মানুষ নদীর পানিই পান করে। নদীর নির্মল পানিই আসল। অল্প-স্বল্প নোংরা সেই পানিকে অপবিত্র করতে পারে না। পবিত্র ধর্মকে কিছু নোংরামি অপবিত্র করতে পারে না।
ধর্ম এক জিনিস। ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধত্ব আরেক জিনিস এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা ধর্মীয় রাজনীতি আরেক বস্তু। ধর্ম মানুষকে হিংসা ও
কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে, অন্তরে নির্মল হয়ে সুন্দর জীবনযাপনে সহায়তা করে। ধর্মীয় সংকীর্ণতা মানুষকে ছোট করে। ধর্মীয় রাজনীতি মানুষকে অসহিষ্ণু ও হিংস্র করে তোলে।
এই পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে ধর্ম ছিল। ভবিষ্যতেও ধর্ম স্বমহিমায় থাকবে। আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতি থাকতেই হবে। সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিও থাকবে। কেউ কারও সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কেউ কারও জন্য বাধা নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ সহাবস্থান অতীতে যেমন করেছে, এই পৃথিবীতে ভবিষ্যতেও তেমনিভাবে করবে। তবে যখন এই তিনের
মধ্যে কোনো কারণে বিরোধ দেখা দেয়, তখন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য সংবেদনশীলতার সঙ্গে তার মীমাংসা করা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
সাম্প্রতিক মন্তব্য