নারীবাদ মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়, পুরুষের সমান হওয়া!
আমার বাবা-মায়ের চার সন্তান। চারজনই কন্যা। আমি সর্বকনিষ্ঠ। সবার ছোট হওয়ায় আমি বেশ আদরে বড় হয়েছি ঠিকই। কিন্তু যখন বুঝতে শিখলাম, তখনই বিষয়টি উপলব্ধি করলাম যে, আমি আমার বাবা-মায়ের আকাঙ্ক্ষিত সন্তান ছিলাম না।
পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার পরে, তারা নিশ্চয়ই একটি পুত্র সন্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।
বিষয়টি ভাবলে মাঝে মাঝেই আমি বেশ পীড়া অনুভব করতাম। কিন্তু যখন আমার বড় বোনের বিয়ে হলো, তখনই বুঝলাম কেন বাবা-মায়েরা পুত্র সন্তান প্রত্যাশা করেন।
আমার বড় বোন এবং তার স্বামী দুজনই সরকারী চাকুরীজীবী এবং দুজনই প্রায় একই মানের চাকুরী করতেন। আমার বোন শ্বশুরবাড়িতেও থাকতো না বা তার স্বামীর কাছেও থাকতো না। চাকুরীর প্রয়োজনেই তারা দুজন দুই শহরে থাকতো।
আমার বোন তার সন্তানদের নিয়ে তার কর্মস্থলের পাশেই থাকতো। তার ওপর খবরদারী করার কেউ ছিল না, মোটামুটি স্বাধীনভাবেই সংসারের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারতো সে।
তারপরও দেখতাম, আমার বোনের স্বামী নিয়মিতই বাবা-মায়ের সংসারের খরচ ও তার ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করতো, কিন্তু আমার বোন দু-একটি উপহার ব্যতীত, কখনই আমার বাবা-মায়ের সংসারের বা আমাদের তিন বোনের লেখাপড়ার কোনো খরচ বহন করেনি। কিন্তু সে ইচ্ছে করলেই পারতো, কারণ সে স্বাবলম্বী ছিল।
তারপরও আমার বাবা কিন্তু থেমে যাননি, তার বাকি তিন কন্যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন এবং আমরাও যথারীতি বড় বোনের দেখানো পথ অনুসরণ করেছি। ঈদের দিনে আমরা সবাই থাকি শ্বশুরবাড়িতে, আমার বাবা-মা একাই ঈদ উদযাপন করেন।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের বেশিভাগ কর্মজীবী নারীরা এভাবেই তাদের বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করে যাচ্ছেন।
সমাজ অনেক বদলে গেছে। এখন বাবা-মায়েরা কন্যা সন্তানদের লেখাপড়া করাতে আর দ্বিধা বোধ করছেন না, কিন্তু কোথায় যেন তাদের একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকছে।
এই দীর্ঘশ্বাস কেবল পুত্র সন্তানহীন বাবা-মায়েরাই ভেতরে ভেতরে অনুভব করেন। যে কারণে এখনও অনেক পরিবারই কন্যা সন্তানের জন্মকে স্বাগত জানাতে পারে না।
ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কন্যা ভ্রূণ হত্যার খবর এখনো পাওয়া যায়। যেমন ভারতে শিশু হত্যা: ১৯টি ভ্রূণ উদ্ধার করলো পুলিশ!
এর দায় কিন্তু এখন আমাদেরও বহন করে বেড়াতে হবে। কারণ, একজন পুত্র সন্তান যেভাবে তার বাবা-মায়ের সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, আমরা নারীরা কিন্তু সেভাবে দায়িত্ব পালন করি না।
সচেতনভাবেই সেসব দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের বুঝতে হবে, কন্যা সন্তানের বাবা-মায়েরাও কিন্তু অনেক কষ্ট করে, টাকা-পয়সা খরচ করে তাদের আদরের কন্যাটিকে মানুষ করছে। তারাও এক সময় বৃদ্ধ হয়ে যায়, তাদেরও একটা আশ্রয় বা অবলম্বন দরকার হয়।
অনেকেই হয়তো বলবেন, শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর খবরদারির কারণেই, ইচ্ছে থাকার পরও নারীরা পারছে না তাদের মা-বাবার পরিবারের দায়িত্ব নিতে। সেই সুযোগটা কি আমরা নারীরাই তাদেরকে দিচ্ছি না?
কারণ, আমরা মেয়েরা এখনও স্বামীর কাছে শিশু হয়ে থাকতেই পছন্দ করি। মুখে মুখে আমরা পুরুষের সমান অধিকার চাই, কিন্তু বিয়ে করার সময় ঠিকই নিজের চেয়ে বয়সে বড় এবং অধিক যোগ্য পুরুষকেই বেছে নেই।
যে মানুষটি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং আমার চেয়ে বেশি আয় করে, সে তো চাইবেই আমি তার কথায় ওঠাবসা করি এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই পুরুষের পরিবার আমার ওপর খবরদারি করবে।
একজন প্রতিষ্ঠিত পুরুষ অনায়াসে অল্প শিক্ষিত, বেকার নারীকে বিয়ে করে সংসার করছে। কিন্তু আমরা নারীরা কখনই কোনো বেকার পুরুষকে বিয়ে করতে রাজি হই না।
এখনও মেয়েরা চায়, স্বামীরা তাদের শাসন করুক। নিজের মাথার চুলটা পর্যন্ত স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাটতে চায় না তারা, পাছে স্বামী যদি আর তাকে পছন্দ না করে।
আর নিজের চেয়ে বয়সে ছোট একজন পুরুষকে বিয়ে করা তো এখনও আমাদের সমাজে একটা লজ্জার বিষয়।
এই লজ্জা এমনভাবে আমাদের সমাজে ঢুকে গেছে যে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনও আমাদের প্রভাবিত করতে পারছে না।
ঐশ্বরিয়া রাই এর সুন্দর একটি পোশাক বা সাজগোজ আমাদের আকৃষ্ট করে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন আমাদের আকৃষ্ট করে না মোটেও। তার মত করে বয়সে দুই বছরে ছোট একজন পুরুষকে বিয়ে করতে লজ্জা পাই আমরা নারীরাই।
তখন বলি, এসব তারকাদের জীবনেই সম্ভব।
এমনকি ধর্মও আমাদের নারী সমাজের এই মানসিকতাকে বদলাতে পারছে না। প্রচুর ধনসম্পদের মালিক, ৪০ বছর বয়সী খাদিজা (রাঃ) বিয়ে করেছিলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সী নবী মুহম্মদ (সাঃ) কে ।
আমরা মুখেমুখেই শুধু পুরুষের সমান অধিকার চাই, কিন্তু পুরুষের মত করে সংসারের দায়িত্ব নিতে এখনও অনেক ভয় পাই আমরা।
একজন উচ্চশিক্ষিত চাকুরীজীবী পুরুষ যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা তারও চেয়ে কম শিক্ষিত ও কম বয়সী নারীকে বিয়ে করে তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিচ্ছে, একজন উচ্চ শিক্ষিত চাকুরীজীবী নারীও যদি অল্প শিক্ষিত, কম বয়সী কোনো বেকার পুরুষকে বিয়ে করে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দেয়, তবে স্বামীরাও নিশ্চয়ই স্ত্রীদের ময়লা কাপড় ধুয়ে দিবে, রান্না করে খাওয়াবে, এমনকি সন্তানেরও দেখাশুনা করবে।
তখন নিশ্চয়ই স্বামীদের খবরদারি সহ্য করতে হবে না মেয়েদের, ইচ্ছে মত নিজের বাবা-মায়ের দেখভালও করতে পারবে তারা। কিন্তু কজন মেয়ে পারছে, জীবন নিয়ে এভাবে চিন্তা করতে?
একজন বেকার পুরুষকে বিয়ে করার সৎ সাহসই বা আছে কজন নারীর? নারী বেকার থাকলে দোষ নেই। কিন্তু, এই সমাজে পুরুষের বেকারত্ব যেন একটি মহাপাপ।
চরম নারীবাদীরাও হয়তো মানতে পারেন না যে, তার স্বামীর কোনো আয় নেই বা তার স্বামী বয়সে ছোট।
আমরা কথায় কথায় পুরুষের দোষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু নিজেদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কখনই মুখ খুলি না। নারীবাদী হতে গিয়ে, আমরা অনেকটাই পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছি, যা আসলে আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শেখায়।
বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যদি বেগম রোকেয়ার নাম আসে, তবে তার আগে আসা উচিৎ রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের এবং স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের নাম।
কারণ, সেই সময়ে মুসলমান সমাজে মেয়েদের ঘরের বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না। ফলে রোকেয়া স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখতে পারেননি। তার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের রোকেয়াকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।
আর রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়াকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন এবং নারী শিক্ষার জন্য স্কুল নির্মাণে অর্থ সঞ্চয় করেন।
সেসব স্কুলে লেখাপড়া করেই আমরা আজ পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছি। সব পুরুষ যেমন ইব্রাহীম সাবের বা সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের মত উদার ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের নয়, সব নারীও তেমনি নারীবান্ধব নয়।
ক্ষেত্র বিশেষে নারীরাই নারীদের সবচে বড় প্রতিবন্ধকতা।
সংসারে নতুন বউয়ের সাথে ঝগড়াটা কিন্তু ননদ-শাশুড়ির মধ্যেই বেশি হয়। চাকুরীজীবী নারীরা সংসারের কাজে সময় দিতে না পারলে শাশুড়িই কিন্তু সবার আগে কথা শোনান।
অফিসে পদন্নোতি হলে, আপনার নারী সহকর্মীটিই কিন্তু সবার আগে মুখ বাকিয়ে নোংরা ইঙ্গিত করেন। আর এভাবে এগিয়ে যায় পুরুষরাই।
তাই পিছিয়ে পড়া এই নারী সমাজে টিকে থাকতে হলে, শুধু পুরুষ বিদ্বেষ নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে যেতে হবে।
রোকেয়া লিটা
লেখক সাংবাদিক
সিঙ্গাপুর
সাম্প্রতিক মন্তব্য