নৈতিকতা ও মূল্যবোধ
মনুষ্যত্বববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই ‘মানুষ’— এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি–রহস্য, একটুখানি সহায়তা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি নম্রতা, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। ‘মানুষ’ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–“ভালো–মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়—এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।”
শিক্ষার সাথে মনুষ্যত্বের সম্পর্ক নিবিড়। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সার্বিক বিকাশের পথ। প্রকৃতি প্রদত্ত জ্ঞানের সর্বোত্তম ব্যবহারে যার দক্ষতা যত বেশি সে তত শিক্ষিত। শিক্ষা মূলত সেই বস্তু যা সকল অনিয়ম থেকে, সকল অকল্যাণ থেকে, সকল অসুন্দর থেকে আমাদের মুক্ত রাখে এবং নিয়মে, কল্যাণে, সুন্দরে আমাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে —-সুনীল আকাশের মতো, অতল সমুদ্রের মতো, মহৎ সূর্যালোকের মতো, নির্মল বায়ুর মতো, অজস্র নিয়মের মতো আমাদের আপন মহিমায় আপন করে নেয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মুক্ত চিন্তার, মুক্তবুদ্ধির এবং নিজেকে প্রকাশের সর্বোত্তম সুযোগ লাভ করে মনুষ্যত্বের চর্চার পথ সুগম, সুন্দর ও পরিশুদ্ধ করে।
শিক্ষা ও নৈতিকতা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতো। মানবিক নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর, যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতা পূর্ণ শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রাখে। শিক্ষার জন্য শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে না। যে শিক্ষা মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় সাধন করে তাই নৈতিক শিক্ষা। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের মাঝে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। নৈতিকতার স্বরূপ প্রকাশিত হয় সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবাদী মনোভাব প্রভৃতি গুণের সমাবেশের মাধ্যমে। আমাদের মহৎ, সৎ ও সুন্দর জীবন–যাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। মানুষের বড় সম্পদ হলো মূল্যবোধ। নৈতিক শিক্ষা নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম দেয়। প্রকৃতিলব্ধ জ্ঞানের সাথে অর্জিত জ্ঞানের সুসমন্বয়ই নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের মূল ভিত্তি। মনুষ্যত্ব অর্জনের অন্যতম নিয়ামক হলো নৈতিক শিক্ষা। মানুষের জীবনের যাবতীয় কল্যাণকর, শুভবুদ্ধি ও শুভচিন্তা এবং তার বিপরীত বুদ্ধি ও চিন্তা বিচারের আপেক্ষিক মানদণ্ডই হলো নৈতিক মূল্যবোধ। নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের জীবন ব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে সুন্দরভাবে, নির্মলভাবে পরিচালনার অনুসরণযোগ্য কিছু আচরণ।
নৈতিক আদর্শ সম্বলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকে না। ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব থেকে সমাজ মুক্ত থাকলেই তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে মনের দিক দিয়ে সম্পদশালী করে তার মনে প্রশান্তি এনে দেয়। যার বলে বলীয়ান হয়ে একজন মানুষ হয়ে ওঠে সকল প্রকার কলুষমুক্ত। সে সত্যকে সত্য বলে চিনতে পারে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে স্বীকৃতি দেয় যা নৈতিক মূল্যবোধেরই ফল। তার আদর্শ সবার কাছে অনুসরণ যোগ্য। কাজেই মানুষের আত্মিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ একান্ত জরুরি। সেই মূল্যবোধের শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। একটি শিশুকে মূল্যবোধ শিখাতে হয় নানাভাবে। সালাম দেওয়া, বিদায়ের সময় মহৎ কামনা করা, ধন্যবাদ জানানো, মিথ্যা না বলা ইত্যাদির মাধ্যমে একটি শিশুকে শিখাতে হয়। পরিবারে যে শিক্ষা শিশু গ্রহণ করতে থাকে তা পরবর্তীতে পূর্ণতা পায় স্কুলে গিয়ে। শিশু শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে চলতে থাকে। সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম, দয়া, ক্ষমা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, মানবতাবোধ ইত্যাদির শিক্ষা শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। যে শিক্ষা মানুষের বুদ্ধির বিকাশ বা হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না সেই শিক্ষা শিক্ষা নয়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়লেও সে নৈতিক শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
নৈতিকতার অভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই। মানুষ মানবতা ভুলে নিজের পশুত্বকে জাগিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও ঔপন্যাসিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছেন, “মানুষের আদিমতা ও হিংস্রতা সহজাত, সেরকম বুনো পরিবেশ পেলে মানুষ তার সভ্যতার লেবাস খুলে হিংস্র হয়ে ওঠে।” আমাদের সমাজের মানুষ নৈতিক শিক্ষার অভাবে নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। চারদিকে কেবল ঠকানোর প্রতিযোগিতা। অন্যায় করে কে কত বড় হতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় উন্মাদ হয়ে ছুটছে সবাই। মানুষ নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে আসে। এরপর পরিবেশ তথা গোটা জীবন এই পৃথিবীতে শিক্ষা গ্রহণ করে। যদি মিথ্যাচার, আদর্শহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ঘুষ,জালিয়াতি, রাহাজানি প্রভৃতি সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে নিমজ্জিত থাকে তবে মানুষের উন্নতির পরিবর্তে অধঃপতনই ঘটবে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার যেমন আশা করা যায় না আবার ছোটরাও অনেক সময় ভালো কিছু গ্রহণ করতে নারাজ। ঘরে–বাইরে আজ মানুষের দৈন্যের চিত্র। দেখা যায় বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও ‘এ’ প্লাস এবং জীবনের উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় না কোনো মহত্তর জীবনবোধ।
যে সব নৈতিক গুণ মানব চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তার মধ্যে সততা একটি মূল্যবান এবং মহৎ গুণ। যে সমাজে সততার মূল্য নেই, সেই সমাজে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। সততাকে বাদ দিয়ে মানুষ নৈতিক বলে বলীয়ান হতে পারে না। সততার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো লোভ–লালসা। সীমাহীন উচ্চ বিলাস মানুষকে অসৎ পথে ধাবিত করে। ফলে মানুষ ভুল পথে পা বাড়ায় এবং বিবেকহীন আদর্শবর্জিত অমানুষে পরিণত হয়ে দেশ জাতি ও সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
নৈতিকতা মানব চরিত্রকে সুশোভিত করে। শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করলে এই সমাজ, মানুষ, পৃথিবী নিয়ে তাদের কোনো সম্যক ধারণা থাকবে না। পরিবার থেকেই শিশুদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে হবে। অভিভাবকগণকে শিশুদের পড়া–লেখার প্রতি শুধু উদ্বিগ্ন না থেকে তাদের প্রতিদিন কিছু নৈতিক শিক্ষা দিতে আগ্রহী থাকতে হবে। তারা যাতে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে তার জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকরা আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,গল্প, ছড়া এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা তার শিশুকে জানাতে পারে।
নৈতিক শিক্ষা বিকাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা হওয়া উচিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকে। শিক্ষকরা তাদের মধ্যে সততা, দায়িত্ববোধ,স্বচ্ছতা, নৈতিকতা, বড়দের সম্মান করা,ছোটদের স্নেহ করা এইসব মানবীয় গুণে বলীয়ান করতে পারে। প্রতিদিন একটি নীতিবাক্য শিখানোর মাধ্যমে ক্লাস শুরু করা একজন শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শিক্ষকের শেখানো একটি নীতিবাক্য একজন শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে অন্যতম নিয়ামক। তাছাড়া শিক্ষকের কাছে অগ্রসর ও অনগ্রসর সকল শিক্ষার্থী সমান মর্যাদা পেলে শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর মানসে এটি স্থান পায় নৈতিক গুণ হিসেবে। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নত জাতি সৃষ্টি করা। শিক্ষকরাই পারেন একজন শিক্ষার্থীর মাঝে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে।
জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করতে অবশ্যই নৈতিকতার মাধুর্যের উৎকর্ষ–সাধনা করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনে ন্যায়–নীতি, মানবিক মূল্যবোধ ও মহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে সত্য ও ন্যায় কর্মে সচেতনতার জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। সমাজ জীবন থেকে অনৈতিকতা ও মূল্যবোধহীনতা দূর করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রকে ও জাতিতে সব ধরনের বিভেদ, অন্যায়–অনিয়ম ও অবিচারের অবসান ঘটাতে হবে। জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধের মহাসমাবেশ ঘটাতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে—তবেই পৃথিবীতে উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব। আর সকল মানুষের অন্তরে ধারণ করতে হবে —- নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনো নৈতিকতা সম্পন্ন জীবন হতে পারে না। সব ধরনের অসত্য, অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতিমুক্ত জীবনই আদর্শ মানবজীবন। আর মানবজীবনের সাধনাই হলো শিক্ষা, প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা তথা মনুষ্যত্ব অর্জন।
ফেরদৌস আরা রীনু
লেখক , প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক
সাম্প্রতিক মন্তব্য