পরির মত মেয়ে সালু আর শোকাকুল মায়ের গল্প

সালুর শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার মা। প্রায় সারাদিন সারারাত সালুর কবরের কাছে বসে থাকতো সে। বাড়ির অন্য মহিলারা মাকে ঘরে নিতে এলে মা বলতো, ‘পকুর ঘরবাড়ি সবতো আগুনে জ্বলছে, ঐ আগুনের মধ্যে কিভাবে যাবো আমি’? নানাবিধ চিকিৎসায় প্রায় একবছর পর ভাল হন আমার মা।

:
আমরা বর্তমানে ৭-ভাইবোন বেঁচে আছি মার সন্তান হিসেবে। আমার বড় বোনের পরই জন্ম নিয়েছিল মার ২য় মেয়ে ‘সালু’। আমার বাবা ও মা ফর্সা-শ্যামলা থাকার কারণে আমরা ভাইবোনেরা কেউ ফর্সা, কেউ শ্যামলা হয়েছি। আহামরি রঙ বা সৌন্দর্যের কেউই হয়নি আমাদের মধ্যে, কেবল মার ‘সালু’ ছাড়া। ব্যক্তিক্রমি আমার এ বোন মানে মার ২য় সন্তানটি হয়েছিল দুধে আলতা বর্ণের, সুন্দর নাক, চোখ, ভ্রু আর চমকপ্রদ মোহময় চেহারার অধিকারী। গ্রামে এমন মেয়ে খুব কমই জন্মেছিল তখন। সৌন্দর্য ছাড়াও বুদ্ধিমত্তায় চমকিত করেছিল সে বাড়ির সবাইকে। এমনসব আচরণ আর বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলতো যে, সবাই বিস্মিত হতো ৮-বছরের এ মেয়েটির কথা শুনে।

:
ঘরের সামনে একটা সুপোরি গাছ ছিল আমাদের। ৭-বছরের বোন ‘সালু’ মাকে বললো, ‘মা চলো এ সুপোরি গাছে ‘দা’ দিয়ে আমি একটা বড় দাগ দেই, তুমি একটা দাগ দাও’। মা বললো, ‘কেন’? সালু বললো, ‘যাতে তুমি মরে গেলে ঐ দাগটা স্পর্শ করে তোমার কথা মনে হয় আমার। আর আমি মারা গেলে ঐ দাগটা স্পর্শ করবে তুমি আমার কথা মনে করে’।

:
একবার আকাশে খুব কালো মেঘ উঠলে ‘সালু’ স্কুল ফেলে দৌঁড়ে বাড়ি চলে এলে মা কারণ জানতে চাইলে সালু বললো, ‘ঝড় বৃষ্টিতে এতো তিল, মরিচ, ডাল তুমি একা ঘরে তুলবে কিভাবে? সবতো ভিজে যাবে। তোমার বড় মেয়ে এটা চিন্তা করেনি স্কুলে ক্লাস করছে সে কিন্তু তোমার কথা চিন্তা করে দৌঁড়ে চলে এলাম আমি’। কথা বলতে বলতে হঠাৎ খুব বৃষ্টি শুরু হলে সালু প্রথমে মার সাথে ডাল, তিল গোল করতে লেগে গেলো এবং চাটাই দিয়ে ঢাকতে দেরি হওয়াতে সালু ঐ ডাল আর তিলকে বৃষ্টি থেকে রক্ষার্থে নিজের পরনের কাপড়, আর নিজ শরীর দিয়ে ঢেকে রাখলো যতক্ষণ না মা তা পুরো ঢাকতে পারলো। রাতে ঘুমোতে গেলে মার কাছে জানতে চাইতো সালু, ‘মা বড় আপার বিয়ের কথা বলছো, আমাকে কেন বিয়ে দাওনা’? আচ্ছা বিয়েতে কি রঙয়ের শাড়ি পরবো আমি? আমি পালকিতে উঠলে তুমি কি কাঁদবে? কাঁদলে কিন্তু আমি নেমে আসবো পালকি থেকে’।

:
আজ থেকে প্রায় ৬০/৬৫-বছর আগের ঘটনা। আমার দ্বীপগ্রামে কোন ডাক্তার ছিলনা তখন। ‘সালু’র সম্ভবত পেটে বড় কৃমি হয়েছিল অনেক। যাকে ‘ফেসিওলা’ রোগ বলে। মানুষের কলজে কামড়ে ধরে এ জাতীয় কৃমিরা। এক প্রচন্ড গরমের দিনে তার নাক ও মুখ দিয়ে বড় কৃমি বেড় হতে থাকে অনেক। বুক বা ফুসফুস সম্ভবত আটতে দিয়েছিল ঐ কৃমিরা। ‘সালু’ শ্বাস করতে পারছিলো না। গ্রাম্য কোয়াক চিকিৎসরা বললো, ‘গরমে কৃমি বুকে উঠে গেছে, তাই তারা তা ঠান্ডা করার জন্যে পাকা কলা আর ডিম ভেঙে সালুর বুকে আর পিঠে দিতে থাকলো অনবরত কিন্তু ক্রমে সালু জ্ঞান হারালো’। ঐ সময় ইঞ্জিনচালিত নৌকোও ছিলনা গাঁয়ে। তাই হাতে বাওয়া নৌকাযোগে সালুকে শহরে নিতে নিতে মারা গেল আমার মায়ের পরির মত ৮-বছরের আদুরে কন্যা সালু। বলতে গেলে বিনে চিকিৎসা আর অজ্ঞতায় মারা গেল আমার এ বোনটি। আমরা সাত ভাইবোন সবাইন উচ্চশিক্ষত এখন। আমার ধারণা আমার এ বোনটি বেঁচে থাকলে আমাদের চেয়েও্ উচ্চতর শিখর ছুঁতো সে!

:
সুমির মেয়ে সুতপার বয়স এখন ৮। আমার পরির মত বোন সালুও মারা গিয়েছির ৮ বছর বয়সেই, আমার জন্মের অনেক আগে। আধুনিক শহুরে মানুষ হিসেবে নানাবিধ চিকিৎসা সুবিধা ভোগ করি আমরা। ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে শরির চেকাপ করয়েছি বেশ কবার আমি। অথচ আমার এমন ফুটফুটে বোনটি মারা গিয়েছিল ৩-দিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করে। অজ্ঞতা আর চিকিৎসাহীনতার কারণে যথাযথ চিকিৎসা হয়নি তার।

:
মাকে হারোনার পর প্রেতময় ঘোরগ্রস্ত লাটিমের ঘুর্ণনের মত জীবনপথে ঘুরেছিলাম আমি, মা যেমন ঘুরেছিল তার সালুকে হারিয়ে। মার ভালবাসাহীন বিশুষ্ক ঠনঠনে জীবনমাঠের মেঘ-নিগড়ে জেগে থাকা জলছবিরা কেঁদে মরে তাই হয়তো আমার জীবনে। যা ভুলে থাকতে এ জীবনের পলিমৃত্তিকা সৃষ্টির আদিমাতার মতো তথাকথিত সুখময় কবিতা লিখে যাই আমি আমাদের জীবন ট্রাকের নীলজলে। অনেক দিন পর মার কথা আর মার সালুর কথা মনে পড়ে জীবনঘুড়ি হারিয়ে যায় ক্ষণিকের জন্যে। তারপরো দিগ্বিদিক ভালবাসা বেঁচে থাকে আঁধারের সমকাল ধরে এ বন্ধুর পথে-প্রান্তরে। তাই হয়তো আমরা সবাই হেঁটে চলি প্রাচীন প্রেমজ সমতট শহরে, জনান্তিকে, মেঠোপথে, মা আর সালুদের ভুলভুলাইয়ার হাঁটে! শাওনমেঘের কর্দমাক্ত ভেজা মাঠময় জীবনটা হয়তো এমনই দু:খাতুর আর পিচ্ছিল আমাদের সবার কমবেশি।

 

You may also like...