বৃক্ষা ও আমার নতুন খোঁজা পথ

বাংলাদেশের গহিন জঙ্গলের ম্যাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ আমি। বান্দরবান জেলার সাঙ্গু নদীর তীরঘেষে হিলি, তিলি আর টিলি পাহাড় অববাহিকায় বসবাস আমাদের এ সম্প্রদায়ের। আজ বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার পাশের তিংপাং গাঁয়ের বৃক্ষা ম্যাকমার সাথে। বৃক্ষাকে একসাথে বিয়ে করতে যাচ্ছি আমরা ৩-ভাই। এটাই আমাদের জাতিগোষ্ঠীর রীতি। মানে যে কজন ভাই থাকে আমাদের সম্প্রদায়ে তারা একসাথে বিয়ে করবে যে কোন নারীকে। এটাই কাল পরিক্রমায় চলে এসেছে এ সম্প্রদায়ের মাঝে যুগ যুগ ধরে। সম্ভবত আমাদের সম্প্রদায়ে নারী সল্পতার কারণে এ রীতির আবির্ভার। দুপুরে বর সেজে ৩-ভাই একসাথে বের হই তিংপাং যেতে। বৃক্ষা ম্যাকমার বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানের। পুরোহিত আমাদের ৩-ভাইর হাতে একসাথে সমর্পন করে বৃক্ষাকে। বর ভোজনশেষে তিংপাং থেকে ৩-ভাই একসাথে তুলে নিয়ে আসি বৃক্ষাকে আমাদের তিলিপাড়ার ঘরে!
:
বৃক্ষার সাথে পূর্বে পরিচয় ছিল আমার। তাই মনে মনে চাইছিলাম তার সাথে বিয়ে হোক আমার। কিন্তু বিয়ে হয়েছে একসাথে আমাদের ৩-ভাইয়ের। রীতি অনুসারে প্রথমে আমার বড়ভাই ফুলশয্যা করলো তার সাথে। ঘন্টাখানেক পর সে বের হলে ঢুকলো ২য় ভাই। সবশেষে আমার পালা। কিন্তু ততক্ষণে বৃক্ষাকে ভোগ করে গেছে আমার দুই ভাই। তাই কাঁদছে সে বিছানায় বসে। আমার গলা ধরে বললো – এটা চায়না সে। সে একান্তই আমার হতে চায়। কিন্তু কিভাবে সম্ভব তা! জাতি ও বংশ পরম্মপরায় চলে এসেছে এ রীতি যে, কোন পরিবারে যেই স্ত্রী আসুক, সে হবে সকল ভাইর যৌথ সম্পত্তি। আমার আর বৃক্ষার চাওয়াতে হয়না কিছু। যা হওয়ার তাই হতে থাকে প্রতিরাতে। দিনকে দিন অসহ্য হতে থাকে বৃক্ষার সাথে ৩-ভাইর এ সম্পর্ক।
:
খবর এলো কাল বৃক্ষার ছোটবোন পুষ্পা ম্যাকমার বিয়ে। সুতরাং আমাদের ৩-ভাইকে যেতে হবে বৃক্ষাসহ। পরদিন সকালে বৃক্ষাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম তার বাবার বাড়ির মেয়ে দেখা অনুষ্ঠানে। পুষ্পাকে দেখতে এসেছে ছেলেপক্ষের মা ও একসাথে ৬-ভাই যথাক্রমে তুলা ম্যাকমা, যাদু ম্যাকমা, হালুই ম্যাকমা, পরহুই ম্যাকমা, কালহি ম্যাকমা ও বারুই ম্যাকমা। পুষ্পাকে পছন্দ হয়েছে তাদের। এবার বিয়ের তারিখ নির্ধারণের পাকা কথা হচ্ছে। চোখের ইশারায় বড়বোন বৃক্ষা ডাকে ছোটবোন পুষ্পাকে। ঘরের কোণে নিয়ে চোখ ভিজিয়ে বলে – “৩-জনকেই সামলাতে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে আমার। তুই ৬-জনকে কিভাবে সামলাবিরে পুষ্পা”? পুষ্পা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনা! কিন্তু যখন বড়বোন বৃক্ষা সব বুঝিয়ে বলে তাকে, তখন ভয় পেয়ে যায় সে। সমর্পণে অতিথিদের সামনে এসে বলে – “এ বিয়া করুম না আমি”! সবাই বিস্মিত হয় পুষ্পার কথায়। কিন্তু বড়ভাই অতিথিদের বুঝিয়ে বলে – “এটা কিছু না, মেয়ে মানুষের কথার কোন দাম নাই, বিয়ে হবে যথা সময়ে”! কিন্তু পুষ্পা অনড় থাকে তার তার কথাতে। বৃক্ষা এসে সাহস দেয় পুষ্পাকে। ভাইদের সাথে তর্ক জুড়ে দেয়ে বৃক্ষা। ৬-ভাইর সাথে একজনের বিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় সে। বাড়ির শান্তিময় পরিবেশ মূহূর্তে অগ্নিগর্ভ হয়। ৬-ভাই আর তাদের মা অপমানিত হয়ে শাসিয়ে যায় বৃক্ষার বড় ভাইকে!
:
সমাজ আর পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়াতে ২-বোনকে অবরুদ্ধ করে ভাই আর ওর মা। আটকে রাখা হয় ২-বোনকে। এতোক্ষণ কোন কথা বলিনি আমি। এবার বৃক্ষার পক্ষ নেই আমি। নানাবিধ যুক্তি তুলে তাকে মুক্ত করতে বলি ওর ভাইকে। আমার সাথেও বিরোধ লাগে ঐ পরিবারের। শেষে কথা হয়, ভোর হলেই বৃক্ষাকে নিয়ে চলে যাবো আমি। কখনো এ বাড়ি আসতে পারবে না বৃক্ষা। আর পুষ্পার ‘বিচার’ হবে কাল ম্যাকমা গোত্রের নিয়ম অনুসারে। শাস্তিস্বরূপ হয়তো ঐ ৬-ভাইর সাথেই বিয়ে হবে তার! রাত গভীর হলে কে বা কারা আগুন দেয় বৃক্ষাদের ঘরে। দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে পুরো ঘর ময়। আগুনের লেলিহান তাপে ঘুম ভাঙে আমার। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে বের করি বৃক্ষা আর পুষ্পাকে। ওদের নিয়ে পেছনের বৃক্ষরাজির আড়ালে পালিয়ে যাই দ্রুত। বৃক্ষাকে বলি চলো আমাদের বাড়ির দিকে যাই। কিন্তু বৃক্ষা বলে – “না বাড়ি যাবোনা, আমরা যাবো ঢাকা পুষ্পাসহ। ওকে উদ্ধার করতে হবে আমাদের। আর আমিও মুক্তি চাই ঐ নরক যন্ত্রণা থেকে!
:
৩-জনে হাত ধরাধরি করে হাঁটি অন্ধকারের মধ্যে। রাত ভোর হওয়ার আগেই সাঙ্গু তীরে পৌঁছে যাই আমরা। নদীতীরের তবলু ম্যাকমাকে ডেকে তুলি ঘুম থেকে। ঐ রাতেই আমাদের নিয়ে যেতে হবে দোহাজারি। যেখান থেকে ট্রেনে ঢাকা যাবো আমরা ৩-জনে। তবলু তার নৌকোয় তোলে আমাদের। সারারাত স্রোতের অনুকুলে নৌকো বেয়ে বর্মাপাড়ায় পৌঁছতে ভোর হয় আমাদের। ঢাকার ট্রেন আসতে তখনো দুঘন্টা বাকি। প্লাটফর্মের এক কোণায় অপেক্ষা করতে থাকি গভীর উৎকণ্ঠায় আমরা। আকস্মিক চোখে পড়ে আমার বড় দুভাই আর বৃক্ষার ভাইকে। যারা ৩-জনে পুরো প্লাটফর্মে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। দোহাজারি স্টেশন টয়লেটের পেছনে সরে যাই আমরা। ওরা ৩-জনে এমাথা ওমাথা করতে থাকে ক্রমাগত। ঢাকাগামী ট্রেন এসে থামে দোহাজারি স্টেশনে। লোকাল ট্রেন তাই যাত্রী মালপত্রের ভীড়ের ফাঁকে ৩-জনে উঠে বসি ট্রেনে এক দৌঁড়ে। হাজারো মানুষের ভীড়ে ওরা লক্ষ্য করেনা আমাদের। ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা বাজে। দূরে আমাদের ৩-ভাইদের চারদিকে দৌঁড়াদৌড়ি করতে দেখি। কোন কোন কামড়ায় উঁকি দেয় তারা।
:
বাঁশি বাজিয়ে সবুজ পতাকা নাড়ে গার্ড। ট্রেনের ধীর গতি ক্রমে বাড়তে থাকে। জানালার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকি আমরা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো ৩-ভাইর দিকে। ট্রেন গতিশীল হলে ঢাকায় ফোন লাগাই প্রতাপ ম্যাকমাকে। যে কাজ করে ঢাকার অত্যাধুনিক ‘বিজু গার্মেন্টস’য়ে। আমাদের জন্য কথা বলে রেখেছে ম্যানেজারের সাথে। আমরা ঢাকা গেলেই কাজে লাগাতে পারবে ওখানে আমাদের। আমরা ৩-জনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকি ঢাকাগামী ট্রেনে। আমাদের চোখে এক নতুন স্বপ্ন। গুলশানের বিজু গার্মেন্টস-এ কাজ করছি আমরা। ছেড়ে এসেছি বান্দরবানের ম্যাকমা সমাজের পৌরাণিক রীতিনীতি। ট্রেনে ছুটে চলেছে ঢাকার দিকে!

You may also like...