মানব বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – কিভাবে আমরা সেপিয়েন্স হলাম (প্রথম পর্ব)
হোমো সেপিয়েন্স খুবই অদ্ভুত একটি প্রাণি। আমাদের পূর্বসূরিরা প্রথমে গাছে বাস করতেন, আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে তারপর তারা মাটিতে – নিচে নেমে এসেছিলেন, তারপর তারা দ্বিপদী প্রাণিতে পরিণত হয়েছিলেন এবং অবশেষে পুরো পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করেছিলেন – আর সেখান থেকেই অসীম সম্ভাবনার অভিমূখে তাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন। আচরণের এই পরিবর্তন এখনোও সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর অন্যতম, কিন্তু আমরা এটি সমাধান করার পথে রয়েছি, প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞানগুলোর বিস্ময়কর সাম্প্রতিক অগ্রগতির কল্যাণে।
জীবাশ্মীভূত ডিএনএ পৃথক, সংগ্রহ আর অনুক্রম করার মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে আমরা এই পৃথিবীটিকে কমপক্ষে আরো তিনটি মানব প্রজাতিদের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, এবং আমরা জানি যে, সেপিয়েন্সরা, আফ্রিকার একটি প্রজাতি – যারা আফ্রিকার বাইরে দুটি অন্য প্রজাতির সাথে আন্তঃপ্রজনন করেছিল। নতুন জীবাশ্ম থেকে আমরা আরো প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি, আমাদের পূর্বসূরিরা শুধুমাত্র পূর্ব আফ্রিকায় উদ্ভুত হয়নি, বরং আসলেই তারা একটি সমগ্র-আফ্রিকার প্রজাতি ছিলেন। আমরা আরো আবিষ্কার করেছি যে, ইতোপূর্বে যা আমরা ভাবতাম, তার চেয়ে আরো এক লক্ষ বছর আগে সেপিয়েন্সরা আসলেই প্রথমবারের মত তদের সমগ্র-আফ্রিকাব্যাপী সূতিকাগারটি ত্যাগ করেছিল।
যদিও বহু বছরের গবেষণার মাধ্যমে হোমো সেপিয়েন্সদের সম্বন্ধে আমরা ইতোমধ্যে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছি, কিন্তু কিভাবে আমরা বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে মানুষে পরিণত হয়েছিলাম সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে এখনো বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন আছে । জলবায়ুর পরিবর্তন কি আমাদের তথাকথিত পূর্বসূরিদের জঙ্গল থেকে সাভানার সমতল অভিমূখে যাত্রাটিকে পরিচালিত করেছিল, যা ধারাবাহিক কিছু জটিল শারীরস্থানিক ও কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা করেছিল? এটি কি তবে বাইপেডালিজম বা দ্বিপদী হবার কারণে ঘটেছিল, যা অন্য কাজের জন্য আমাদের হাতগুলোকে মুক্ত করেছিল? হাতিয়ারের ব্যবহার? আমাদের বড় মস্তিস্ক? তবে আমরা কি মানুষে পরিণত হয়েছি, কারণ আমরা সহমর্মী এবং সহযোগিতা করতে সক্ষম?
দীর্ঘ সময় ধরে, বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব ছিল। তারপর, ২০১৫ সালে আমরা বিস্ময়কর একটি আবিষ্কার করেছিলাম : ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগে, যে এলাকাটি বর্তমানে কেনিয়া, হাত দিয়ে বানানো পাথরের হাতিয়ার বা উপকরণ। সবচেয়ে প্রাচীনতম মানব জীবাশ্মটির সময়কাল পরিমিত হয়েছে ২.৮ মিলিয়ন বছর, সুতরাং যে হাত এইসব হাতিয়ার তৈরি করেছিল সেগুলো অবশ্যই মানুষ হতে পারে না। এই হাতগুলো খুব সম্ভবত ছিল অষ্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতিদের সদস্যদের, প্রাক-মানব একটি প্রজাতি। তাহলে হাতিয়ার আমাদের মানুষে পরিণত করেনি।
এই সংবাদটি আমাদেরকে আরো মনোযোগ সহকারে আমাদের পূর্বসূরিদের পর্যবেক্ষণ করতে প্ররোচিত করেছিল, সেপিয়েন্সদের সম্বন্ধে আরো নতুন কিছু যা আবিষ্কারের কারণ হয়েছে। এই ধারাবাহিকে ‘হমিনাইজেশন’ বা মানবে পরিণত হবার প্রক্রিয়ার আনুক্রমিক পর্বগুলো নিয়ে মূলত আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে, অর্থাৎ প্রাক-মানব পর্ব থেকে হোমো হিসাবে বিবর্তনীয় রূপান্তর ( যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মানুষে রূপান্তরিত হবার সাংস্কৃতিক দিকগুলোও), অস্ট্রালোপিথেকাসদের সাথে যা আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল তিন মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় পূর্ব থেকে। এটি ছিল বিস্ময়কর একটি রূপান্তর, যে রূপান্তরটি একটি অদ্ভুত, অনন্য, ঋজু প্রাণিদের সৃষ্টি করেছিল, যাদের শক্তিশালী বৌদ্ধিক ক্ষমতা আছে, যাদের সবেচয়ে বিবর্তিত রূপটি, সেপিয়েন্স, এর সব পূর্বসূরিদের বংশঐতিহ্য ধারণ করে।
আমরা এখন জানি যে, সেপিয়েন্সদের অগ্রসর বৌদ্ধিক ক্ষমতার প্রাথমিক ভূমিকা হচ্ছে আমাদের টিকে থাকতে সহায়তা করা। কিন্তু কোথায়? প্রকৃতিতে, নাকি, সমাজে? প্রকৃতিতে যখন একা, সেপিয়েন্সরা তখন দূর্বল, কিন্তু দলবদ্ধভাবে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে সবেচেয়ে দুর্ধর্ষ শিকারি। পরিবেশগতভাবে এটি অসম্ভব অনুভূত হয় : একটি সর্বব্যাপী প্রজাতি যারা প্রকৃতিকে তাদের বাসস্থানে পরিণত করেছিল – যে বাসস্থানটি এখন বৈশ্বিক মাত্রা অর্জন করেছে। এই ধারাবাহিকে এই রহস্যময় বিবর্তনীয় কাহিনিটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হবে। এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রাণির ইতিহাস: আপনি।
প্রথম অধ্যায় : নরবানরের উত্তরসূরি এক দ্বিপদী
“প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার প্রাচীন প্রাইমেটদের প্রথম মানুষ রূপে বিবর্তিত হবার চালিকা শক্তি ছিল। এটি শুধুমাত্র আমাদের পূর্বসূরিদের দ্বিপদী প্রাণিতেই রূপান্তরিত করেনি, মাটির উপর সোজা হয়ে হাঁটতে পারার ক্ষমতা, চলাফেলার জন্য যা অনেক বেশি দক্ষতর একটি উপায় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু এছাড়াও এটি একটি স্ব-দৃঢ়ীকরণের চক্রের সূচনা করেছিল: যত বেশি দ্বিপদী তারা হয়েছিল, মাটিতে প্রয়োজনীয় সম্পদ আরোহণ করতে তত বেশি তারা সফল হয়েছিল, যা দ্বিপদী আচরণকে আরো দৃঢ়তর করেছিল..। যদিও, শুধুমাত্র এটি ব্যাখ্যা করতে পারে না, কেন মানুষরা স্থায়ীভাবে দ্বিপদী প্রাণিতে পরিণত হয়েছিল”।
১৭৪৮ সালে, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মত মানুষরা প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদ্ভিদ ও প্রাণীবিজ্ঞানী কার্ল লিনেয়াস (১৭০৭-৭৮) তার “সিস্টেমা নাটুরি” ( দ্য সিস্টেম অব নেচার – প্রকৃতির পদ্ধতি) বইয়ে সমজাতীয় এক গোষ্ঠী প্রাণিদের সাথে আমাদের বিন্যস্ত করেছিলেন – একটি জিনাস বা গণ – যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “হোমো”, এবং আমাদের শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন “সেপিয়েন্স” হিসাবে, যার অর্থ “জ্ঞানী”। আজ, হোমো সেপিয়েন্স হচ্ছে একমাত্র অস্তিত্বশীল মানব রূপ।
স্তন্যপায়ী প্রাণি হিসাবে – উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট প্রাণী যারা তাদের সন্তানদের প্রতিপালন করে – সেপিয়েন্সরা প্রাইমেট অর্ডার বা বর্গের সদস্য: পাঁচ আঙ্গুলসহ সামনের দিকে ফেরানো চোখ, এবং বসে থাকা অবস্থায় সোজা বা ঋজু শরীরের নরবানর (এইপ)। আমাদের জানা নেই কবে প্রাইমেটরা প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল, কিন্তু আমরা জানি যে ইকোসিন পর্বে তাদের ইতোমধ্যেই অস্তিত্ব ছিল, যে পর্বটি আজ থেকে ৫৬ থেকে ৩৩.৯ মিলিয়ন বছর পূর্বে ছিল। কোথা থেকে তারা বিবর্তিত হয়েছিল? আমরা সেটিও নিশ্চিতভাবে জানি না, কিন্তু ৭০ মিলিয়ন বছর আগে, যখন ডায়নোসররা পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল, সেই সময়ও একটি আদি-প্রাইমেট (প্রোটোপ্রাইমেট) প্রজাতিরও অস্তিত্ব ছিল, “পার্গাটোরিয়াস” নামে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে – ইদুর আকারের ক্ষুদ্র একটি প্রাণি। তবে যখন ডায়নোসরদের আধিপত্য সমাপ্ত হয়েছিল, তখন আধুনিক স্তন্যপায়ীরা, প্রাইমেটরাসহ, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমানে, অধিকাংশ প্রাইমেটরাই ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাসিন্দা এবং বৃক্ষবাসী জীবনাচরণের সাথে যারা অভিযোজিত, যা ইঙ্গিত করে মানুষের সবচেয়ে প্রাচীনতম পূর্বসূরি – হোমিনিড এইপ বা নরবানররা – ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে বাস করতো, যেখানে গাছগুলো ছিল দীর্ঘ, ফল ছিল প্রচুর। বর্তমানে অধিকাংশ হোমিনিড নরবানররা আফ্রিকায় বসবাস করে, মানব প্রজাতি উৎসস্থল হিসাবে যা আফ্রিকার প্রতি ইঙ্গিত করে।
প্রাক-মানব হোমিনিন
পর্যাপ্ত পরিমান প্রমাণ এখন আমাদের কাছে আছে, যেগুলো এসেছে আফ্রিকা মহাদেশে খুঁজে পাওয়া বহু সংখ্যক প্রাগৈতিহাসিক হোমিনিন জীবাশ্ম থেকে, যা প্রস্তাব করছে যে “হোমো” – দের জন্ম হয়েছিল আফ্রিকায়।
বর্তমানে, হোমিনিড পরিবারে অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা হচ্ছে : মানুষ, বনোবো, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং উটান (ছবি ১)। এছাড়াও আমরা বহু জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছি, বিশেষ করে “আর্ডিপিথেকাস”, “প্যারানথ্রোপাস” এবং “অস্ট্রালোপিথেকাস”, যারা ছিল আমাদের প্রাক-মানব পূর্বসূরি, অর্থাৎ হোমিনিনরা, যারা শিম্পাঞ্জির চেয়ে আমাদের অনেক বেশি নিকটাত্মীয়। তাহলে হোমিনিড পরিবারকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি সেইসব গ্রেইট এইপ বা নরবানরদের পরিবার হিসেবে, যাদের মানবসদৃশ রূপ আছে এবং দুই পায়ের উপর ভর করে হাঁটার একই ধরনের ক্ষমতা আছে।
খুব দূর্লভ জীবাশ্মীভূত হাড়ের খণ্ডাংশ রূপে প্রমাণ আছে যে, ৭ মিলিয়ন বছর আগে হোমিনিন পরিবারের ইতোমধ্যেই অস্তিত্ব ছিল । এইসব জীবাশ্ম খণ্ডাংশগুলো আসলে কী তথ্য উন্মোচিত করে? আসলেই,খুব বিস্ময়কর একটি তথ্য: আর সেটি হচ্ছে হোমিনিন বিবর্তনীয় বৃক্ষটি আসলে অনেকটাই একটি ঝোপের মত দেখতে, যা প্রদর্শন করে হোমিনিনরা ধারাবাহিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনীয় ধাপগুলোর মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছিল। যে পর্বগুলোয় বেশ কিছু সম্পর্কযুক্ত পরিবার, যাদের প্রায় এই ধরনের শারীরিক গঠন ও জীবনাচরণ ছিল, তারা একই সময়ে সহাবস্থান করেছিল।
এই বিবর্তনীয় ধাপগুলোর প্রথমটি হচ্ছে বৃক্ষবাসী চতুষ্পদী অঙ্গস্থিতি থেকে একটি ক্রটিপূর্ণ বাইপেডাজিম বা দ্বিপদী অঙ্গস্থিতি, অর্থাৎ এইসব হোমিনিনরা দুই পায়ের উপর ভর করে হাঁটতে পারলেও তাদের বৃক্ষবাসী জীবনাচারণ অব্যাহত রেখেছিল। কিছু জীবাশ্ম নমুনা, যেগুলোর সাথে আপনি হয়তো ইতোপূর্বে পরিচিত থাকতে পারেন, সেগুলো হচ্ছে, “টুমাই”, ৭ মিলিয়ন বছর প্রাচীন একটি “সাহেলানথ্রোপাস চাদেনসিস” প্রজাতির নমুনা, “ওরোরিন টুগেনেনসিস”, ৬ থেকে ৫.৭ মিলিয়ন বছর প্রাচীন একটি নমুনা, এবং প্রায় পাঁচ মিলিয়ন বছর আগের একটি প্রজাতি “আরডিপিথেকাস”। দ্বিপদী হবার সবচেয়ে প্রাচীনতম দাবীদার হচ্ছে “টুমাই”, আমাদের কাছে এর শুধুমাত্র উরুর হাড় বা ফিমারের একটি খণ্ডাংশ আছে, এবং একটি খুলি, যা প্রাচীন চাদ হৃদের কাছেই পাললিক স্তরের মধ্যে খানিকটা বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এর আবিষ্কারক কলেজ দ্য ফ্রান্সের একজন জীবাশ্মবিদ মিশেল ব্রুনেটের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এর অক্সিপিটাল ফোরামেন বা ছিদ্রটির – যে ছিদ্রটি মস্তিস্কের খুলির বেস বা নীচে থাকে যেখান থেকে মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ড মস্তিস্কের সাথে সংযুক্ত হয় – অবস্থান খুলির পেছনে নয় বরং বেশ মাঝামাঝি একটি অবস্থানে থাকার বিষয়টি খুব শক্তিশালীভাবে ইঙ্গিত দেয় “টুমাই” ইতোমধ্যেই সোজা হয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে অর্থাৎ একটি ঋজু দেহভঙ্গিমা ও অঙ্গস্থিতি অভিযোজিত করে নিয়েছিল (ছবি ২)। আর একারণে, ব্রুনেট টুমাইকে হোমিনিন বংশধারার সদস্যদের মধ্যে একটি হিসাবে বিবচেনা করেছিলেন, যা তখনও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল একটি সাধারণ পূর্বসূরির সাথে যা আমরা শিম্পাঞ্জিদের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও এখনও এই দাবী নিয়ে কিছু অমীমাংসিত বিতর্ক আছে, বিশেষ করে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বাইপেডালিজমের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য আদৌ যথেষ্ট হতে পারে কিনা। এটি নির্ধারণ করা বেশ কঠিন একটি কাজ এই মুহূর্তে, বিশেষ করে এই প্রজাতির আর কোনো নমুনা আমরা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মানব বংশধারার আরেকটি প্রাচীন সদস্য হচ্ছে “ওরোরিন টুগেনেনসিস। ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরি দুইজন জীবাশ্মবিদ – ব্রিজিট সেনুট এবং মার্টিন পিকফোর্ডের আবিষ্কৃত ওরোরিন সম্বন্ধে আমরা জানি ডজনখানেক জীবাশ্ম নমুনা থেকে, যে খণ্ডাংশ চার জন স্বতন্ত্র সদস্যের, যাদের কেনিয়ায় তিনটি পৃথক স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই হোমিনিনের ক্ষেত্রে, এর ফিমারের আকার ও গঠন, অন্যান্য পূর্ববর্তী হোমিনিড প্রজাতির চেয়ে আরো বেশি মাত্রায় হোমো সেপিয়েন্সের ফিমারের মত, এবং এটির আকৃতি ইঙ্গিত দিয়েছিল একটি ঋজু দেহভঙ্গিমার, যখন কিনা এর নরবানর সদৃশ বাঁকানো বৃদ্ধাঙ্গুল গাছে বেয়ে ওঠার আচরণের সাথে অভিযোজিত ছিল, সুতরাং এটিও বৃক্ষবাসী জীবনাচরণের ইঙ্গিত দিয়েছিল। আর্ডিপিথেকাসের নমুনাগুলো আবিষ্কৃত হয়েছিল ইথিওপিয়ায় – আরডিপিথেকাস কাডাব্বা ( ৫.৮ মিলিয়ন থেকে ৫.২ মিলিয়ন বছর আগে), এবং এর সম্ভাব্য উত্তরসূরি আরডিপিথেকাস রামিডাস (৪.৪ মিলিয়ন বছর আগে) – এই জীবাশ্মগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল এবং সেকাকরণে অনেক বেশি তথ্যের যোগান দিয়েছিল (ছবি ৩)
আপাতদৃষ্টিতে যে হোমিনিনরা বিবর্তনের এই ধাপ অবধি পৌঁছেছিল সেগুলো শুধুমাত্র ক্রটিপূর্ণ একটি দ্বিপদী আচরণ প্রদর্শন করেছিল: তাদের পাগুলো যদিও হাঁটার জন্য যথেষ্ট পরিমানে অভিযোজিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের হাতের “অপোজেবল” বৃদ্ধাঙ্গুলটি ( অপোজেবল মানে বৃদ্ধাঙ্গুলটিকে সামনে দিকে নাড়ানো যায় এবং একই হাতে অন্য আঙ্গুলগুলোকে স্পর্শ করা যায়) ছিল শিম্পাঞ্জি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের মত। যদিও “হাটার বৃদ্ধাঙ্গুলটি” আরডিপিথেকাসদের মাটির উপরে হাঁটার দক্ষতা গুরুতরভাবে সীমাবদ্ধ করেছিল, কিন্তু এটি খুব দ্রুত গাছে বেয়ে ওঠার জন্য তাদের সুযোগ করে দিয়েছিল, যেহেতু তাদের হাতে তখনও দীর্ঘ আঙ্গুল ছিল – যা বৃক্ষবাসী বানরদের মত। আরডিপিথেকাস প্রজাতিগুলোর একটি, সম্ভবত আরডিপিথেকাস রামিডাস, এরপর প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন বছর আগে “অস্ট্রালোপিথেকাস” -এ বিবর্তিত হয়েছিল, খুব সম্ভবত “অস্ট্রালোপিথেকাস আমানেনসিস”, ( ছবি ৩)।
অস্ট্রালোপিথেকাসদের পদাঙ্ক অনুসরণ
উপযুক্তভাবেই, হোমিনিন বিবর্তনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল প্রথম সত্যিকারের দ্বিপদী – অস্ট্রালোপিথেকাস। যদিও এটির জিনাস বা গণের নাম – অস্ট্রালোপিথেকাস শব্দটির অর্থ “দক্ষিণের নরবানর”, নামটি ১৯২৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এটির প্রথম আবিষ্কারের প্রতি তথ্য নির্দেশ করে। অস্ট্রালোপিথেকাসদের জীবাশ্ম নমুনাগুলো পূর্ব আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালিতেও আবিষ্কৃত হয়েছে ( ছবি ৪)। যদিও খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে, তবে অস্ট্রালোপিথেকাসদের সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন যা আমাদের কাছে সেটি কিন্তু জীবাশ্ম নয় আদৌ, বরং কিছু পায়ের ছাপ যা সংরক্ষিত হয়েছিল: এই পায়ের ছাপগুলো সৃষ্টি করেছিল ‘অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস’ প্রজাতির তিন সদস্য, বিখ্যাত ল্যুসি যে প্রজাতির সেই প্রজাতির সদস্য ছিল তারা। প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন বছর আগে, বর্তমান তানজানিয়ায় লায়েটলি নামক একটি এলাকায়, সাডিমান আগ্নেয়গিরি মাটির উপর ছয় ইঞ্চি পুরু ছাইয়ের স্তর বিছিয়ে দিয়েছিল, যা তিন অস্ট্রালোপিথাকা সদস্যের এই পদচিহ্নগুলো সুরক্ষিত করে রেখেছিল, যারা এর মধ্য দিয়ে একত্রে হেঁটে গিয়েছিল।
এই পায়ের ছাপগুলো বিশেষভাবেই আকর্ষণীয়. কারণ এগুলো প্রায় আধুনিক সময়ের মানুষের পদচিহ্নের মত ( ছবি ৫) দেখতে । পায়ের প্রথম আঙ্গুলটি – হ্যালাক্স – গ্রেইট এইপ বা নরবানরদের মত ‘অপোজেবল’ নয়, বরং এটি বাকি চারটি আঙ্গুলের সাথে একই সারিতে সজ্জিত, সেপিয়েন্সদের পায়ের আঙ্গুলের মত। সেকারণে যদিও দুটি প্লান্টার আর্চ ( দৈর্ঘ্য বরাবর এবং আড়াআড়ি) এতটা সুস্পষ্ট না হলেও আমাদের পায়ের সাথে অস্ট্রালোপিথেকাসদের পায়ের বিস্ময়কর সাদৃশ্য ছিল (আমাদের পায়ের হাড়গুলো, টারসাল এবং মেটাটারসাল তিনটি আর্চ তৈরি করে, দুটি দৈর্ঘ্য বরাবর, আরেকটি আড়াআড়ি, এই আর্চ বা খিলানের মত পায়ের বাঁকানো গঠনটি হাটার সময় স্প্রিং এর মত কাজ করে, শরীরে ভার বহন করে এবং হাঁটাচলা করা সময় অভিঘাতগুলো শোষণ করে)। আমরা এই পদচিহ্নগুলো বিশ্লেষণ করলে আরো দেখতে পাই, পায়ের যে অংশটি মাটির উপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে সেটি পায়ের গোড়ালির দিকে, যা ইঙ্গিত করে যে অস্ট্রালোপিতেকাসরা তখনও মানুষের সেই বৈশিষ্ট্যসূচক হাটার পদ্ধতিতে পুরোপুরিভাবে রপ্ত করতে পারেনি: প্রথমে পায়ের আঙ্গুলগুলো পড়বে, এরপর পায়ের প্লান্টার আর্চগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং পরিশেষ গোড়ালি মাটি স্পর্শ করে।
আমাদের হাতের সাথেও তাদের হাতের মিল ছিল, শুধুমাত্র হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের প্রথম অংশটি মানুষের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের মত এত বেশি নড়াচড়া করার স্বাধীনতা দেয়নি। এবং তাদের আঙ্গুলগুলো ছিল দীর্ঘ এবং খানিকটা বাঁকানো। এই হাত, সেই সাথে দীর্ঘ বাহু, সংকীর্ণ কাধ এবং উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে আসা বুকের খাঁচা সেই নমনীয়তা প্রদর্শন করেছিল যা গাছ বেয়ে ওটার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো অষ্ট্রালোপিথেকাসদের অন্য প্রজাতির মধ্যেও আবিষ্কৃত হয়েছে (ছবি ৪), বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেই জীবাশ্মগুলোর মধ্যে – যেগুলোর উৎস ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস ( ৩ থেকে ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে) এবং অস্ট্রালোপিথেকাস সেডিবা ( ২ মিলিয়ন বছর আগে), কিন্তু পরের প্রজাতির ক্ষেত্রে বেশ দীর্ঘ পা একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রার শরীরের আকৃতি ইঙ্গিত করে, যা হোমো জিনাস বা গণের সাথে সংশ্লিষ্ট জীবাশ্ম নমুনাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল ।
এমনকি যদিও অস্ট্রালোপিথেকাসদের আমাদের সমতূল্য হাত এবং পা ছিল, আপাতদৃষ্টিতে সম্ভবত তারা সম্পূর্ণভাবে দ্বিপদী ছিল না। কিছু জীবাশ্মবিদ তাদের বনোবোদের সাথে তুলনা করেছেন, অর্থাৎ তাদের সম্ভবত খুবই বিকশিত সামাজিক জীবন ছিলেন, এবং তাদের বেশির ভাগ সময় কাটাতো মাটিতে খাদ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু তারা বনভূমির গাছের উপর মূলত নির্ভরশীল ছিল। বিশেষ করে, তারা উচ্চতায় নিরাপত্তা খুঁজে পেতো। কিন্তু আমাদের যে বিষয়টি ভাবায় : তারা কি নীড় তৈরি করতো গাছে ঘুমানোর জন্য, শিম্পাঞ্জিদের মত? আর শিম্পাঞ্জিদের আচরণের কথা মনে রেখে, ল্যুসির জীবাশ্ম অস্থিগুলো পুনঃপরীক্ষা করে, ২০১৬ সালে অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জন কাপেলমান এবং তার সহকর্মীরা নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রস্তাব করেছিলেন, ল্যুসি খুব সম্ভবত একটি গাছ থেকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল।
কিছু বিশেষ হোমিনিড জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বাইপেডালিজম বা দ্বিপদী আচরণের প্রতি বিবর্তন সূচনা করেছিল কি? কলেজ দ্য ফ্রান্সের ইভ কপেন্স, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নৃতত্ত্ববিদ ডোন্যাল্ড জোহানসনের সাথে সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ট্রালোপিথেকাস, ল্যুসির জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি জলবায়ুর পরিবর্তনকে এর কারণ হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন, যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল গ্রেটি রিফট ভ্যালি গঠিত হবার ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। এই তত্ত্ব অনুযায়ী – যে তত্ত্বটির তিনি নাম দিয়েছিলেন “ইস্ট সাইড স্টোরি”, এই ভূতাত্ত্বিক ঘটনার পরিণতি ছিল পূর্ব আফ্রিকায় সাভানার দ্বারা বনাঞ্চলগুলোর আংশিক প্রতিস্থাপন। পরিণতে, চতুষ্পদী প্রাইমেটরা যারা বৃক্ষবাসী জীবনাচরণে অভ্যস্ত ছিল, তাদের উন্মুক্ত সমতলে নেমে আসতে হয়েছিল, আর সেই কাজটির জন্য দুই পায়ে ভর করে হাঁটা বিশেষ সুবিধাজনক একটি অভিযোজন ছিল, আর সেটাই দ্বিপদী আচরণ অভিমূখে তাদের বিবর্তনের সূচনা করেছিল।
কিন্তু কপেন্সের তত্ত্বটি, এছাড়াও যে তত্ত্বটিকে ‘সাভানা হাইপোথিসিস’ বলা হয়, সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম পরিবেশগত উপাত্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা প্রদর্শন করেছিল, ওরোরিন, আরডিপিথেকাস এবং এমনকি ল্যুসি একটি মিশ্র ধরনের এলাকা জুড়ে বাস করতো, যেখানে পানির উৎসের নিকটবর্তী ঘন বনাঞ্চল ছিল, ঝোপ কিংবা গুল্মাবৃত সমতল এবং সাভানা ছিল (সাভানা হচ্ছে বনাঞ্চল আর তৃণভূমির মিশ্র একটি পরিবেশ যেখানে বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে বৃক্ষগুলো পরস্পর থেকে যথেষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে সুতরাং ক্যানোপি বা গাছের উপরে পাতার চাঁদোয়া কখনোও পরস্পরের সাথে মিশে বন্ধ হয়ে যায় না।) কিছু গবেষক প্রস্তাব করেছিলেন, আমাদের ঋজু দেহভঙ্গিমা আর অঙ্গস্থিতির সূচনা হয়েছিল আমাদের অতীতের বৃক্ষবাসী জীবনে, এবং খাওয়ার সময় গাছের উপর সোজা হয়ে দাড়ানো একটি সুবিধাজনক আচরণ ছিল। আর সেকারণে আমাদের কাছে এখনও এই প্রশ্নটির সঠিক নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই।
হোমো, বাধ্যতামূলক দ্বিপদী
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনীয় ধাপ – যা আমরা এখনো পেছনে ফেলে আসিনি – সেটি হচ্ছে আবশ্যিক দ্বিপদী আচরণ, সম্পূর্ণভাবে এই জীবনাচরণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মাটির উপর শুধুমাত্র দুই পায়ের উপর ভর করে ঋজু হয়ে হাঁটার জন্য অভিযোজিত। জৈবযন্ত্রসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি বলা হয়, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় এটি তারচেয়ে অনেক বেশি পরিমানে জটিল একটি প্রক্রিয়া, , এই চলাফেরা করার পদ্ধতিটি স্থলবাসী মেরুদণ্ডী প্রাণিদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে স্বাতন্ত্র্যসূচক। বাস্তবিকভাবে, এটি ‘হোমো’ জিনাস বা গণের একটি সংজ্ঞায়িত করার মত বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের অন্য সব হোমিনিডদের থেকে পৃথক করে। কিন্তু কিভাবে এটি ঘটছিল? আমাদের ধারণা অষ্ট্রালোপিথেকাসদের ক্রুটিপূর্ণ দ্বিপদী আচরণটি ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত হবার মাধ্যমে এটি ঘটেছিল । এই মতামতটি সমর্থন করেছিল অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস পায়ের অস্থিগুলো নিয়ে একটি নিবিড় গবেষণা, যা পরিচালনা করেছিলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারল ওয়ার্ড। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, ল্যুসির আত্মীয়দের আর্চযুক্ত পা ছিল, অর্থাৎ তারা ইতোমধ্যেই আমাদের মতই চলাফেরা করার একটি উপায় অভিযোজিত করে নিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে তারা আধা-মানবে পরিণত হয়েছিল।
ঐচ্ছিক থেকে এই বাধ্যতামূলক বাইপেডালিজমে ( দ্বিপদী আচরণ) পরিবর্তন সবচেয়ে প্রাচীন মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট, উল্লেখযোগ্যভাবে ‘হোমো হ্যাবিলিস’দের মধ্যে (২.৮ থেকে ১.৪৪ মিলিয়ন বছর আগে), যারা দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায় বসবাস করতো। যদিও তাদের মস্তিষ্কের খুলি গহবরের ধারণ ক্ষমতা মাঝারি মাপের ছিল, অস্ট্রালোপিথকাসেদের খুলির আয়তনের নিকটবর্তী ( আমাদের বর্তমান ধারণ ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ), বর্তমান সময়ের মানুষের পায়ের সাথে এদের পায়ের বেশ মিল ছিল। একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ জীবাশ্ম যা আমাদের কাছে বর্তমানে আছে, সেটি অনুযায়ী ‘হোমো হ্যাবিলিস’দের পা ছিল অনমনীয়, খিলানের মত একটি আর্চ ছিল এবং অস্থিগুলোর আকার আমাদের পায়ের অস্থিগুলোর মতই ছিল। ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের হোমিনিড চলৎশক্তি বিশেষজ্ঞ ডেলোসিয়ঁর মতে এটি বাধ্যতামূলক বাইপেডালিজম আচরণ ইঙ্গিত করে।
হোমো হ্যাবিলিসদের মতই প্রাচীন এবং পূর্ব আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ, হোমো রুডোলফেনসিস’দের (২.৪৫ মিলিয়ন থেকে ১.৪৫ মিলিয়ন বছর প্রাচীন) আরো শক্তিশালী একটি গঠন ছিল এবং মস্তিস্কের গহবরের ধারণক্ষমতা ছিল খানিকটা বেশি। এছাড়াও এটি আবশ্যিক দ্বিপদী। এভাবে এটি স্পষ্ট যে, আবশ্যিক বাইপেডালিজম হচ্ছে সেই বৈশিষ্ট্য যা হোমো জিনাস বা গণটিকে অস্ট্রালোপিথেকাস গণ থেকে পৃথক করেছে। আর সেকারণে জীবাশ্ববিদদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী হাইপোথিসিসটি হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান বাইপেডালিজম অভিমূখে বিবর্তন অষ্ট্রালোপিথেকাস থেকে একটি মানব রূপ অভিমূখে রূপান্তরের সূচনাটিকে চিহ্নিত করে।
হোমো, পৃথিবীর প্রভু
তাসত্ত্বেও একটি প্রশ্ন অবশিষ্ট থেকে যায়: এই বিবর্তনের সূচনা করেছিল কী? যেহেতু কোনোকিছু অস্ট্রালোপিথেকাসদের একটি বংশধারাকে আরো বেশি মাত্রায় মাটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে, এবং সেটি করতে কম পরিমান শক্তি খরচ করতে বাধ্য করেছিল। আর বহু গবেষণাই এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে। ২০১০ সালে, অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড রাইখলেনের নের্তৃত্বে একটি গবেষক দল উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন, একই পরিমান দূরত্ব অতিক্রম করতে, একটি শিম্পাঞ্জী তার চার-পা ব্যবহার করে যে পরিমান শক্তি খরচ করে, একজন মানুষ দুই পা ব্যবহার করে এর সিকিভাগ পরিমান শক্তি খরচ করে।
এই একই গবেষকরা আরো দেখেছিলেন যে, তারা দুই পায়ে কিংবা চার পায়ে যেভাবেই হাটুক না, উভয় ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জিরা একই পরিমান শক্তি খরচ করে । এভাবে, তারা সোজা হয়ে দাড়িয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে হাটুক কিংবা চারপায়ে হাটার সময় তাদের সব মাংসপেশী ব্যবহার করুক না কেন, তারা সবসময়ই মানুষের চেয়ে বেশি পরিমানে শক্তি ব্যবহার করে। যত শীঘ্রই প্রাচীন হোমিনিনরা মাটির উপর প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ব্যবহার করতে শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল, বিবর্তন শুধুমাত্র কম পরিমান শক্তি খরচ করার অভিযোজনের দিকেই অগ্রসর হতে পেরেছিল, যার অর্থ আরো বেশি পরিমানে বাইপেডালিজ বা দ্বিপদী আচরণ।
অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত আর বিশাল একটি এলাকায় বিচরণ করার আবশ্যিকতা ক্রমবর্ধমান হারে বাইপেডালিজমের সপক্ষেএকটি নির্বাচনী চাপে সৃষ্টি করেছিল। উগান্ডার কিবালে ন্যাশনাল পার্কে, ফেঞ্চ ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরীর সাবরিনা ক্রিফের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল পর্যবেক্ষণ করেছিল, একটি শিম্পাঞ্জির বৈশিষ্ট্যসূচক বসবাসের এলাকা মোটামুটিভাবে আট বর্গ মাইল (২০ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এবং অধিকাংশ সময় তারা এর মাত্র পচিশ শতাংশ এলাকা ব্যবহার করে থাকে। তুলনামূলকভাবে, নৃতাত্ত্বিক গবেষণাগুলো পরিমাপ করে দেখেছে যে, জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ( উষ্ণ এলকায়, সম্পদের প্রাচুর্য আছে, কিন্তু শীতল জলবায়ুতে সম্পদ দুর্লভ হতে পারে), শিকারী-সংগ্রাহক মানুষের একটি দলের প্রায় ৫০০ বর্গ মাইল ( ১৩০০ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। বাইপেডালিজম এছাড়াও খুবই উপযোগী প্রমাণিত হয়েছিল ভূদৃশ্যে বেশ কিছু ভয়ঙ্কর শিকারী প্রাণিদের অবস্থান জরিপ করার জন্য, যারা দুর্বল আর ভঙ্গুর প্রাকমানবদের জন্য খুবই বিপজ্জনক ছিল ( ল্যুসি দৈর্ঘ্যে মাত্র তিন ফুট ছিল)।
একটি শক্তিশালী বিবর্তনীয় বেগবর্ধক
তবে বাধ্যতামূলক দ্বিপদী আচরণের প্রতি আমাদের বিবর্তন প্রক্রিয়াটির কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকতর ব্যবহার অভিমূখে অগ্রগতি সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। স্মরণ করে দেখুন বিবর্তনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপটিতে, বেশ কিছু সম্পর্কযুক্ত অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির সহাবস্থান ছিল। যদিও তারা মূলত দ্বিপদী ছিল, কিন্তু তাদের সবাই বাধ্যতামূলক দ্বিপদী আচরণ বিবর্তন করেনি। এই অদ্ভুত প্রপঞ্চের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে যে, অস্ট্রালোপিথেকাসের একটি বংশধারা তাদের বিবর্তন “তরান্বিত” করেছিল, বাধ্যতামূলক দ্বিপদী আচরণ অভিমূখে যারা অন্যদের চেয়ে আরো দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিল এবং সেকারণে মাটিতে আরো বেশি পরিমানে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করতে অধিকতর সফলতা অর্জন করতে পেরেছিল। সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে ( প্রায় এক মিলিয়ন বছর সময় বিস্তৃতিতে) এই বংশধারাটি এতই প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন যে তারা সম্ভবত প্রথমে একই পরিবেশগত এলাকায়, এবং পরবর্তীতে এর বাইরেওঅন্য সব কটি সম্পর্কযুক্ত প্রজাতির বিলুপ্তি প্রক্রিয়াটির সূচনা করেছিল ।
(চলবে…..)
তথ্যসূত্র:
M. Brunet et al. “A new hominid from the Upper Miocene of Chad, Central Africa.” Nature, 418 (2002): 145–51.
B. Senut et al. “First hominid from the Miocene (Lukeino Formation, Kenya).” Comptes Rendus de l’Académie de Sciences, 332 (2001): 137–44.
M. Pickford et al. “Bipedalism in Orrorin tugenensis revealed by its femora.” Comptes Rendus de l’Académie de Sciences, 228, no. 4 (2002): 191–203.
P. G. M. Dirks et al. “Geological setting and age of Australopithecus sediba from Southern Africa.” Science, 328 (2010): 205–8.
T. D. White et al. “Ardipithecus ramidus and the Paleobiology of Early Hominids.” Science, 326 (2009): 64–86.
Y. Haile-Selassie, G. Suwa, and T. D. White. “Late Miocene Teeth from Middle Awash, Ethiopia, and Early Hominid Dental Evolution.” Science 303, no. 5663 (2004): 1503–05.
C. V. Ward et al. “Complete Fourth Metatarsal and Arches in the Foot of Australopithecus afarensis.” Science, 331 (2011): 750–53.
M. D. Leakey. “The Fossil Footprints of Laetoli,” Scientific American, 246 (1982): 50–57.
J. Kappelman et al. “Perimortem fractures in Lucy suggest mortality from fall out of tall tree.” Nature, 537 (2016): 503–7.
Y. Deloison. “Etude des restes fossiles des pieds des premiers hominidés: Australopithecus et Homo habilis. Essai d’interprétation de leur mode de locomotion. Ph.D. thesis under the direction of Yves Coppens,” Université de Paris V Sorbonne, 1993.
S. Bortolamiol et al. “Suitable habitats for endangered frugivorous mammals: small-scale comparison, regeneration forest and chimpanzee density in Kibale National Park, Uganda,” PLoS ONE, 9 (2014): e102177.
Y. Coppens. Le Singe, l’Afrique et l’homme. Paris: Fayard, 1983.
D. C. Johanson. Lucy’s Legacy: The Quest for Human Origins. New York: Harmony Books, 2009.
I. Tattersall. Masters of the Planet: The Search for Our Human Origins. New York: St. Martin’s Griffin, 2013.
I. Tattersall and R. DeSalle. The Accidental Homo Sapiens: Genetics, Behavior, and Free Will. New York: Pegasus, 2019.
সাম্প্রতিক মন্তব্য