মানুষের ইতিহাস, বিবর্তন তত্ত্ব – আজকের পর্ব ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল এবং মিসিং লিংকের ঝামেলা, মাছের চার পায়ে ডাঙায় উঠার ইতিহাস।
প্রতিটি প্রজাতি ক্রমাগত ভাবে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় প্রতি প্রজন্মে , তবে ফসিল রেকর্ডে এ আমরা কিছু পরিবর্তনের প্রমাণ পাই যা বিস্ময়কর বিবর্তনের জন্য, আজকে তেমন কিছুই ট্রাঞ্জেশনাল ফসিলের কথাই আলোচনা করবো,
বিবর্তন তত্ত্বে মিসিং লিংকের প্যারা –
আগেই বলে রাখছি বিবর্তনের মিসিং লিংক বলে কিছু নেই, মিসিং লিংক আসলে অবৈজ্ঞানিক ধারনা, হয়তো ভাবছেন কি বলছে এই লোক, সারাজীবন বিবর্তন তত্ত্বের মিসিং লিংক খুঁজেছি আর এখন বলছে মিসিং লিংক বলে কিছু নেই, আসলে মিসিং লিংক হচ্ছে সুডো সায়েন্স,এই টার্মটি মূলত ব্যাবহৃত হয় হাইপোথেটিক্যাল
অবস্থান বুঝানোর জন্য, যেমন অর্ধেক শিম্পাঞ্জি এবং অর্ধেক মানুষ, অথবা অর্ধেক ডাইনোসর এবং অর্ধেক পাখি টাইপ কাজকারবার, এটি মূলত উৎপত্তি হয় গ্রীকদের থেকে এবং প্রি-ডারউইনের সময় থেকে চলে আসছিল যার মূলত ফর্মুলা ছিল “গ্রেট চেইন অফ বিং ” নামে,
মিসিং লিংক বিষয়টি পাকাপোক্ত হয় ১৮ শতকের চিন্তাবিদদের মাধ্যমে , যেমন আলেক্সজেন্ডার পো, অথবা জ্যঁ জ্যাক রুশোর , তারা চিন্তা করতেন মানুষ হচ্ছে একটি বিশাল চেইনের অন্তর্ভুক্ত প্রানী, গ্রেট চেইন অফ বিং সমস্ত পদার্থ এবং জীবনের শ্রেণিবদ্ধ সর্বোচ্চ কাঠামো। অ্যারিস্টটলের উচ্চ ও নিম্ন প্রাণীর তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত এই মিসিং লিংক হাইপোথেটিক্যাল চিন্তা ইউরোপের মধ্যযুগীয় সময়ে মজবুত হয়েছিল এবং ধর্মীয় চিন্তায় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই চেইনের সবার উপরে আছে গড তারপর মানুষ এবং তারপর পশুরা, কিন্তু আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী “জন বেপ্টিস্ট লেমার্ক” প্রথমে বুঝতে পারেন লাইফ সিম্পল থেকে কমপ্লেক্স হচ্ছে এবং পারফেক্ট হচ্ছে , মিসিং লিংক মোটেই ডারউইনিয়ান প্যারাডাইম না,এটি মূলত প্রি-ডারউইনিয়ান বিবর্তনের একটা হাইপোথেটিক্যাল চিন্তা।
ট্রানঞ্জেশনাল ফসিল মূলত দুটি প্রাণীর মধ্যকার অনেক দিনের বিবর্তনের মাঝামাঝি অবস্থান, মানে
ট্রানঞ্জেশনাল ফসিল দুটি প্রানীরই (দূর অতীত এবং দূর ভবিষ্যৎয়ের) কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাবে,এর মানে এটি নয় যে এটির পূর্ববর্তী কোন প্রানীর সাথে হুবুহু হবে, যেমন শিম্পাঞ্জির লক্ষ বছর আগের এন্সেস্টরের সাথে আজকের শিম্পাঞ্জির তেমন কোন মিল খুজে পাওয়া যাবে না আবার হাজার বছর আগের শিম্পাঞ্জির কমন এন্সেস্টরদের সাথে কিছুটা মিল খুজে পাওয়া যাবে। এর কারন হচ্ছে স্পেসিয়েশান হয়ে যাওয়া , মানে লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জি বা গরিলারা যাদের থেকে আলাদা হয়েছে তাদের সেই একি অবস্থানে আজকের শিম্পাঞ্জিরা বা গরিলারা নেই, এই কারনেই বিবর্তনকে বলা হয় (Descent with modification ) মনে রাখতে হবে বিবর্তন সরলরৈখিক না বরং গাছের ডালপালার মত বিস্তৃত ভাবে কাজ করে। যদি এটুকু বুঝে থাকেন তাহলে এবার আসুন,
ট্রাঞ্জেশনাল ফসিল নিয়ে আলাপ সালাপ করি।
প্রথমেই এপ্সদের কথা বলি, এপ্স বলতে শুধু শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা বেবুন না মানুষও এরমধ্যে পড়ে, মানুষও এপ্স বা প্রাইমেট, বৈজ্ঞানিকদের মতে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি আলাদা হয়েছে একটি কমন এন্সেস্টর থেকে,প্রায় ৮/৯ মিলিয়ন বছর আগে, জেনেটিক প্রমানে অন্যান্য সব প্রানী থেকে আমরা শিম্পাঞ্জিদের কাছাকাছি, মাত্র ১.২ অথবা ২% ( সায়েন্টিফিক স্টাডিজ-এর কথা যদিও কিছু বেশি কম আছে ) জেনেটিক পার্থক্য আছে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির মধ্যে।
আমরা যেমন অনেক বিবর্তিত হয়ে লক্ষ বছর আগের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে অনেক আলাদা হয়ে গেছি ঠিক তেমনি শিম্পাঞ্জি বা গরিলারাও তাদের কমন পূর্ব পুরুষদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে, আমাদের সেই ৭/৮ মিলিয়ন বছর আগের পূর্বপুরুষের ফসিলের সাথে
আমাদের আজকের পার্থক্য হবে অনেক, তাই ট্রাঞ্জেশনাল ফসিলও অনেক সময় জটিলতা তৈরি করে।
আর্ডিপিথেক্স রামিডাস – আজ থেকে প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন বছর আগে এরা বেঁচে ছিল, আর্ডিপিথেক্স রামিডাসদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল শিম্পাঞ্জিদের মতই, কিন্তু এরা দাঁডিয়ে হাটতে পারতো বলে ধারনা করা হয়, এরা হচ্ছে অস্ট্রেলোপিথিকাস আফেরেন্সিস
দের পূর্ব পুরুষ ।
অস্ট্রেলোপিথিকাস আফেরেন্সিস – এদের ফসিলের বয়স প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন বছর, এদের পূর্ব পুরুষদের
(আর্ডিপিথেক্স রামিডাস -)চাইতেই এরা দক্ষ ভাবে হাটতে পারতো এবং মস্তিষ্কের আয়তন শিম্পাঞ্জিদের মতই ছিল,কিন্তু এরা হোমো সেপিয়েন্সদের সরাসরি পূর্বপুরুষ ছিল না।
অস্ট্রেলোপিথিকাস আফ্রিকানাস – এই প্রজাতির বয়স আজ থেকে আনুমানিক ৩ মিলিয়ন বছর, এরা হোমো হ্যাবিলিসদের পূর্বপুরুষ,
হোমো হ্যাবিলিস – বয়স ২ মিলিয়ন বছর, মাথার মগজের আয়তন আধুনিক শিম্পাঞ্জিদের থেকে প্রায় ৫০% গুন বড়, ফসিলের সাথে পাওয়া গিয়েছিল, পাথরের তৈরি টুলস, এরা হোমো ইরেক্টাসদের আগেও পাথরের টুলস ব্যাবহারকারী প্রজাতি।
হোমো ইরেক্টাস – ১.৭ মিলিয়ন বছর এদের বয়স,
পাথর দিয়ে এডভান্স টুলস বানাতে পারতো, মোটামুটি আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, মস্তিষ্কের সাইজ হচ্ছে ১০০০cc,
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস – বেঁচে ছিল ০.৫ মিলিয়ন বছর আগে, আধুনিক মানুষের কাছাকাছি ছিল মস্তিষ্কের আয়তন, এদের মধ্যেই আধুনিক মানুষ এবং
হোমো ইরেক্টাসদের মিক্সড বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়
মাছ থেকে ট্রেট্রাপড বা চারপায়ের প্রাণী,
ট্রেট্রাপড মানে হচ্ছে চার লিম্বের প্রানী মানে চার হাত পায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটে ,এটির মধ্যে আছে স্তন্যপায়ী,ডাইনোসর, উভয়চর প্রানী
আমাদের জানামতে ডাঙার উঠা প্রথম প্রানী হচ্ছে টিকটালিক নামের একটি উভয়চর, কিন্তু ২০১০ স্টাডি অনুযায়ী আরো কিছু প্রানী পাওয়া গেছে যারা বেঁচে ছিল আজ থেকে প্রায় ৩৯৭ মিলিয়ন বছর আগে এরাও চারপায়ের উভচর ছিল, এর ফলে টিকটালিকের আগেও চারপায়ের উভয়চর ছিল বলে জানা যায়,
মনে রাখতে হবে টিকটালিক বা এর সমসাময়িক ট্রেট্রাপডেরা কিন্ত আধুনিক প্রানীদের সরাসরি পূর্ব পুরুষ নয় বরং তারা আমাদের কমন পূর্ব পুরুষদের সাথে সম্পর্কিত, এবং পানি থেকে উঠে আসা প্রথম
ডাঙার প্রানী বলে পরিচিত।
Eusthenopteron – এটি প্রায় ৩৮৫ মিলিয়ন বছর আগের সামুদ্রিক মাছ জাতীয় প্রানী , ইউস্থেনঅপটারন খুব সম্ভবত কমন এন্সেস্টর সেই গ্রুপের যারা ছিল প্রথম ট্রেটাপড বা চারপায়ের প্রানী, এটির ছিল ট্রেট্রাপড সদৃশ্য খুলি এবং কাটা।
Tiktaalik -টিকটালিক ( ৩৭৫ মিলিয়ন বছর আগের প্রানী যদিও পানিতে বসবাস করতো বলে ধারনা করা হয়, টিকটালিকের ফিন ছিল আবার ট্রেট্রাপডের মত ল্যান্ড ডুয়েলিং পা ছিল, পানিতে শব্দ শুনতে পেত, সুতরাং এটি মাছ এবং ট্রেট্রাপডের মধ্যকার দারুন একটি ট্রাঞ্জেশনাল ফসিলের উদাহারন।
Ventastega – ৩৬৫ মিলিয়ন বছর আগের প্রানী যাকে ধরা হয় টিকটালিক এবং Acanthostega এর মধ্যকার ট্রাঞ্জেশনাল অবস্থান,
Acanthostega – এটির বয়স ও প্রায় ৩৬৫ মিলিয়ন বছর, চার পায়ের প্রাণী, এবং ল্যান্ড ডুয়েলার্স, কিন্তু পা ছিল পানিতে সাতরানের জন্য উপযোগী, এবং লেজ ছিল প্রপলশানের জন্য উপযুক্ত, এবং এর ফুসফুস ছিল বলে ধরা হয়।
এটা ভাবা ভুল হবে যে প্রথম ট্রেট্রাপড একেবারে মাছ থেকে লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠে গেছে, উঠেই সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে, বিবর্তন এভাবে কাজ করে না আসলে, ধীরে ধীরে প্রতি প্রজন্মে কিছু পরিবর্তন হয় ন্যাচারাল সিলেকশান অনুযায়ী সেই র্যান্ডম ভেরিয়েশান গুলোই কখনো কখনো ন্যাচারে স্থায়ী হয়, মাছের পানিতে উঠা বা মাছের উড়তে পারা সম্ভব কিনা তা যাচাই করতে ফ্লাইং ফিস নামে এক জাতীয় মাছ এখনো উড়তে পারে গুগল করে দেখতে পারেন , পানিতে প্রানীদের শরীরের ভার বহন করতে হয়না, কিন্তু ল্যান্ড ডুয়েলার্সদের পায়ের দরকার হয় হাটার জন্য,,
৩৬০ মিলিয়ন বছর আগের ফসিলের মধ্যে একটি জিনিস কমন দেখা গেছে বলে মনে করা হয়, ট্রেট্রাপডের বিবর্তনের প্রথমেই পা পানির নিচে ক্রল করার জন্য বিকশিত হয়েছিল , কেবলমাত্র পরে তারা ডাঙায় উঠে পায়ের ব্যবহারটি সর্বজনীন ভাবে শুরু করেছিল ।
আগামী পর্বে ডাইনোসর এবং এরপরের আলোচনা হবে।
তথ্যসূত্র
১- http://www.transitionalfossils.com/
২ – https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tiktaalik
৩-https://en.m.wikipedia.org/wiki/Missing_link_(human_evolution)
ধন্যবাদ
আগের পর্ব হোমো ইরেক্টাস
https://www.shottershondhane.com/%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%b7%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d/
সাম্প্রতিক মন্তব্য