মুক্ত কর হে বন্ধ- পঞ্চম অধ্যায় (উপনিবেশের যুগ)
উপনিবেশের যুগে বিজ্ঞাপন
১৫০০ সালের আগে পৃথিবী ছিল শত শত ছােট অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত, যেগুলাে মােটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তাদের মধ্যে বাণিজ্য ও পণ্য আদান প্রদান হত, কিন্তু তা সীমিত আকারে। আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশ সম্মন্ধে ইউরােপ খুব একটা জানত না। অষ্ট্রেলিয়া ছিল সম্পূর্ণ অজানা। এশিয়া হতে ইউরােপে স্বল্প পরিমাণ বিলাস দ্রব্য যেত। ১৮০০ সালের আগে (আমেরিকা ছাড়া) পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে ইউরােপের উপস্থিতি ছিল বাণিজ্য কেন্দ্র, অল্প কয়েকটি দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন আর সামুদ্রিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমিত। এশিয়ার মূল্যবান পণ্যদ্রব্য; বিশেষত: মশলার বাণিজ্য অধিকার করার জন্য ইউরােপ থেকে এশিয়ার নৌপথ আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা শুরু হয়, আর পর্তুগীজরা এতে সফল হয়। স্পেনের উদ্যোগে এই প্রচেষ্টার ফল হয় ভিন্ন, আমেরিকা আবিষ্কার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পূর্ণ বদলে যায়। চার শতক ধরে কয়েকটি ইউরােপীয় দেশ বাকী পৃথিবীর প্রায় পুরােটাই দখল করল ও তাদের আর্থসামাজিক গতি প্রকৃতি বদলে ফেলল। শিল্প বিপ্লব ও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়ে গেল অধিকৃত দেশগুলি।
উপনিবেশের যুগে মশলা
মশলার যুগ
যখন থেকে মানুষ আগুন ব্যবহার করতে শিখল, আর আগুনের সাহায্যে রান্না করা শুরু করল, সম্ভবত তখন থেকেই মশলার ব্যবহার শুরু। প্রাচীন কালে দু-একটি মশলা (যেমন সরিষা, জুনিপার juniper ফল) উৎপন্ন হলেও বেশীর ভাগ মশলাই ভারত ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে আসত। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধরনের মশলা পৃথিবীর সব জায়গায় এত সহজে পাওয়া যায় এবং দামও সেই সময়ের তুলনায় এত কম, এটা চিন্তা করাই কঠিন যে কয়েক শত বৎসর আগেও মশলা ছিল দুপ্রাপ্য ও দুর্মূল্য। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন এশিয়ার যে কয়েকটি মূল্যবান পণ্যের কারণে ইউরােপ থেকে এশিয়ায় আসার পথ খোজা শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে মশলাই ছিল প্রধান। এটাই ছিল সমুদ্রজয়ের যুগ। এই পথ খুঁজতে গিয়েই। আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার হয়। এই উদ্যোগ থেকেই উপনিবেশের যুগ শুরু হয় আর পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যায়।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ শতকে মিশরে লবঙ্গ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। লবঙ্গ তখন পৃথিবীর এক জায়গায় উৎপন্ন হত,বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জে। পরবর্তী কালে মিশরে দারুচিনি ও গােলমরিচ এর ব্যবহার বিষয়ে মিশর এর Ebers Papyrus এ লিখা আছে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০)। প্রাচীনকালে ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও দূর প্রাচ্যের সঙ্গে মিশরের যে বাণিজ্য ছিল এটা তার পরিচয়। সম্ভবত এই দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় কয়েকবার পণ্য হাত বদল হত। তাতে তার দামও বেড়ে যেত। সমুদ্রপথে এই বাণিজ্য আরব বণিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এই বাণিজ্য পথের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল ভারতের কেরালা। কেরালা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে আসা মশলার বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়াও গােলমরিচ উৎপাদন ও বিক্রয়ের কেন্দ্র ছিল। বণিকেরা দক্ষিণ ভারত থেকে আরব উপদ্বীপ ও মিশর হয়ে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরােপের গ্রীস ও রােমে মশলা পৌছে দিত। মশলা বাণিজ্য এতই লাভজনক ছিল যে আলেকজান্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২-৩৩১ সালে মিশর বিজয়ের পর মূলতঃ মশলা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর পত্তন করেন। এই বন্দর প্রধানত মশলা বাণিজ্যের শুল্ক আদায় করেই সম্পদশালী হয়। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রােমান সাম্রাজ্যের উত্থানের পর আলেকজান্দ্রিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বন্দর নগরীতে পরিণত হয় এবং মশলা বাণিজ্যের সবচাইতে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। রােমানরা ভারত পর্যন্ত নিজেরাই বাণিজ্য পথ স্থাপন করে এবং আরবদের সমান্তরালে চালাতে থাকে। রােমানরাই প্রথম ব্যাপকভাবে Preserved খাদ্য (বিশেষ করে মাংস) মশলা ব্যবহার করে উপাদেয় করে তােলার ব্যবস্থা করে। রােমান রান্নার বইয়ে এর পরিচয় পাওয়া যায়। মশলা এত মূল্যবান ছিল যে এটা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হত। কোন কোন স্থানে মজুরী হিসেবে গােলমরিচ দেওয়া হত। রােমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কালে ৪৪১ খ্রিষ্টাব্দে ভিসিগথ (Visigoth) আলরিফ যখন রােম জয় করেন, তখন রােমানদের প্রাণের বিনিময়ে তিনি ৩০০০ গােলমরিচ দাবী করেছিলেন।
Calicut, India as rendered in 1572. Europe used brutal tactics in India and Southeast Asia in efforts to get in on the spice trade. Image is from Georg Braun and Franz Hogenber’s atlas Civitates orbis terrarum.
পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে বিভিন্ন ধরনের মশলা আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে আধুনিক যুগের সূচনা হয় মশলা বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে। ঐ সময় মশলার ব্যবহার ছিল খাদ্যদ্রব্য বিশেষত মাংস সংরক্ষণ করার জন্য। সংরক্ষিত খাদ্য যখন পরে ব্যবহার করা হত তখন এর স্বাদ বাড়ানাের জন্য মশলা
ব্যবহার করা হত। ঐ সময় ইউরােপে শীতকালে খাদ্যশস্য, শবজী ইত্যাদি উৎপাদন কম হত। তাই শীতকালে ব্যবহারের জন্য খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ না করে উপায় ছিল না। আর দীর্ঘ দিন খাদ্য সংরক্ষণ করায় খাবার এ টাটকা খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ তাে থাকতই না, বরং স্বাদ ও গন্ধ বিকৃত হয়ে যেত। তাই যারা কিনতে পারত, তারা মশলা কিনে তার সাহায্যে স্বাদ ও ঘ্রাণ উন্নতি করার চেষ্টা করত। এছাড়াও মশলার ব্যবহার ছিল প্রসাধনী দ্রব্য প্রস্তুতে এবং ভেষজ ঔষধ তৈরীতে। মৃত ব্যক্তির সত্ত্বারেও মশলার ব্যবহার ছিল।
কিন্তু ইউরােপ ছিল মশলা বাণিজ্যের একদম শেষ মাথায়। গােলমরিচ উৎপন্ন হত দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। আর দারুচিনি উৎপন্ন হত শ্রীলংকায়। লবঙ্গ ও জায়ফল উৎপন্ন হত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালাক্কায়। এইসব স্থান থেকে খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকেই আরব ও উত্তর আফ্রিকার বণিকরা ইউরােপে মশলা নিয়ে আসত। ফলে মশলা ইউরােপে ছিল খুবই উচ্চমূল্যের। ১৩০০ শতকে এক সময় ইউরােপে এক পাউন্ড জায়ফলের দাম ছিল সাতটা স্বাস্থ্যবান ষাঁড়ের সমান। ধনী লােকদের পক্ষেও মশলা ব্যবহার করা কঠিন ছিল। ১৪০০ শতকে যখন নৌ-পরিবহন ও জাহাজ পরিচালনা পদ্ধতির উন্নতি হল যাতে করে দূরপাল্লার জাহাজ চলাচল সম্ভব হল, তখন ইউরােপের রাজা রাণীরা মশলা বাণিজ্যে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হল।
আরবদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর আরবদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করে। মুসলিম আরবরাও মশলা – বাণিজ্যে নিয়ােজিত ছিল এবং তাদের মাধ্যমেই মশলা বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলিতে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। দশম শতকে প্রায় সম্পূর্ণ মশলা-বাণিজ্য পথ আরব মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে মুসলিম বিজয়ের সাথে সাথে ইউরােপের সঙ্গে বাণিজ্য কমে আসে এবং অষ্টম শতকে খুবই সীমিত হয়ে পড়ে। দশম শতকে মিলান, জেনােয়া ও অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় নগর রাজ্যের উত্থানের ফলে বাণিজ্য কিছুটা বাড়ে।
Colonial Spices & Herbs by Patricia B. Mitchell
ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে একাদশ শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত সময় ছিল সফল ধর্ম বিস্তার এর কাল। এই সময় প্রায় সমস্ত ইউরােপ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিয়াস-১ সেলজুক তুর্কদের আক্রমণ হতে তার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য খ্রিষ্টানদের প্রতি আহবান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১০৯৫ সালে পােপ দ্বিতীয় আরবান (Urban) ধর্মযুদ্ধের আহবান জানান। ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড এর ফলে খ্রিষ্টানরা জেরুজালেম দখল করে এবং সেখানকার অধিবাসীদের হত্যা করে। ফেরার সময় খ্রিষ্টান যােদ্ধারা ধনসম্পদ নিয়ে আসে। কিন্তু এই সম্পদের মধ্যে সােনা রূপার চাইতেও মূল্যবান মশলা ছিল বেশী।
এশিয়ার জীবনযাত্রা ক্রুসেডের যােদ্ধাদের প্রভাবিত করে। এর একটা বড় প্রভাব ছিল রান্নায় মশলার ব্যবহার। সমুদ্র পথে ভেনিস এই মশলার-বাণিজ্যের ইউরােপীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সময় চেংগীজ খান (১১৬২ – ১২২৭ খিস্টাব্দ) এর নেতৃত্বে মঙ্গোলরা বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করে। এটা চীন থেকে ইউরােপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাদের রাজত্বে এশিয়া থেকে স্থলপথে মশলা আমদানী শুরু হল। চতুর্দশ শতকে প্লেগ এর মহামারী এশিয়া থেকে ইউরােপে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় অটোমান সম্রাটরা কনস্ট্যান্টিনােপােল দখল করে। স্থলপথে বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়ার মাধ্যমে | নৌপথে ভেনিস পর্যন্ত মশলার বাণিজ্যের প্রধান পথ হয়ে দাড়ায়।
A-SHORT-HISTORY-OF-THE-JOURNEY-OF-SPICES
পঞ্চদশ শতকে জাহাজ চলাচলের প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দূরপাল্লার নৌ বাণিজ্য সম্ভবপর হল। পর্তুগাল ও স্পেন এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিল। পর্তুগীজরা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ দিক ঘুরে সমুদ্র পথে ভারতে পৌঁছানাের চেষ্টা চালাচ্ছিল। এই উদ্দ্যেশ্যে তারা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর অনেকগুলাে ব্যবসা-কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস নামে এক জেনােয়াবাসী স্পেনের রাজা রাণীর আনুকূল্যে ভারত পৌঁছানাের জন্য পশ্চিম দিকে তিনটি জাহাজ নিয়ে যাত্রা করেন। সেই সময় পৃথিবী গােলাকার এটা অনেকেই সঠিক বলে মেনে নিয়েছিলেন। পশ্চিম দিকে ইউরােপ ও এশিয়ার মধ্যে যে আমেরিকা নামে একটা বড় মহাদেশ আছে তা জানা ছিল না। ফলে কলম্বাস এক মাস পর যেখানে পৌছালেন তা তিনি ভারত মনে করলেও আসলে তা ছিল বাহামা দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। যদিও এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা কিন্তু এই আবিষ্কার পৃথিবীর বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে অনেক পরে।
সেই সময়ের অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন এনেছিল ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে যাবার পথ আবিষ্কার। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল এর পৃষ্ঠপােষকতায় ভাস্কো-ডা-গামা পূর্বে স্থাপিত বাণিজ্য কেন্দ্র ধরে এগিয়ে ১৪৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আফ্রিকার দক্ষিণ দিকে পূর্ব উপকূলে যেতে সক্ষম হন। মােজাম্বিক পৌছে তিনি আরব বণিকদের সন্ধান পান। ইবনে মজিদ নামে একজন আরব বণিকের সাহায্যে কেরালার কালিকট বন্দরে ২০শে মে ১৪৯৮ সালে পৌঁছান। এই যাত্রায় ভাস্কো- ডা- গামা বিনিময়ের জন্য তেমন কোন পণ্য নিয়ে আসেন নি। ১৫০২ সালে তিনি বিশটি জাহাজ নিয়ে দ্বিতীয়বার আসেন ও কালিকট দখল করেন। এবার তিনি এত মশলা নিয়ে লিসবনে ফিরে আসেন যে মশলার দাম কমে ভেনিসের তুলনায় লিসবনে এক-পঞ্চমাংশ হয়ে যায়। আরব ও ভেনিসের বণিকদের আধিপত্য এইভাবে ভেঙ্গে দেয় পর্তুগীজরা। এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
মসলা দ্বীপপুঞ্জ এবং অনুসন্ধানের সময়
স্পেন ও পর্তুগাল রাজ্য জয়ের প্রতিযােগিতায় নেমে পড়ল। এটা এত প্রকট আকার ধারণ করল যে ১৪৯৪ সালে পােপ আলেকজান্ডার (চতুর্থ) এর মধ্যস্থতায় ইউরােপের বাইরের বিশ্বকে ৪৬° পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ দ্বারা দুইভাগে ভাগ করে পূর্ব অংশ পর্তুগাল ও পশ্চিম অংশ স্পেনকে দেওয়া হল। স্পেন ও পর্তুগাল দুই রাজ্যই এটা মেনে নিল। এই সময় পর্তুগীজ অভিযানকারী (explorer) পেদ্রো আলভারজ কাবরাল পশ্চিম দিকে নৌ অভিযান চালিয়ে ব্রাজিলের উপকূলে পৌছেন। হিসাবের ভুলের কারণে এটা সীমানা রেখার পূর্বদিকে বলে ধরা হয় এবং পর্তুগাল তার অধীনস্ত এলাকা বলে নিয়ে নেয়। পর্তুগালের আর একজন অভিযানকারী আলফোনসাে ডি আলবুকার্ক ১৫১১-১২ সালে ভারতের গােয়া দখল করেন। এরপর তিনি বর্তমান মালয়েশিয়ার মালাক্কার সুলতানের রাজ্য দখল করেন। এক বৎসরের মধ্যে তিনি সেখানকার সব মুসলিম অধিবাসীকে হত্যা করেন। আলবুকার্ক এর স্থাপন করা বন্দর মালাক্কা থেকে আন্টোনিও ডি আবরু ১৫১২ সালে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার মলুক্কা দ্বীপপূঞ্জের দিকে রওনা হন। তিনি বান্দা দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন। বান্দা দ্বীপপুঞ্জ ছিল সেই সময় জায়ফলের এবং জয়ত্রীর পৃথিবীতে একমাত্র উৎস। এইভাবে পর্তুগীজরা অনেক ধরনের মশলার উৎপাদন স্থলে পৌছে যায়।
মশলা সংগ্রহের বিকল্প পথের খোজে স্পেন ফার্দিনান্দ ম্যাগিলানকে ১৫১৯ সালে আমেরিকার দক্ষিণ দিক ঘুরে পশ্চিম দিকে অভিযানে পাঁচটি জাহাজ দিয়ে পাঠাল। তিনি প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ফিলিপাইনে পৌছেন। স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে তিনি যুদ্ধে নিহত হন। শেষ পর্যন্ত তার নাবিকেরা একটি মাত্র জাহাজ ভর্তি মশলা নিয়ে ১৫২২ সালে স্পেন পৌছে। স্পেন ও পর্তুগালের এই দ্বন্দ্ব ১৫৮০ সালে শেষ হয় যখন পর্তুগাল স্পেনের অধীনে চলে যায়। ফলে স্পেন সমস্ত মশলা বাণিজ্যের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় এবং মশলার দাম বাড়াতে থাকে। এর ফলে ইউরােপের অন্যান্য নৌ শক্তি বৃটেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড মশলা বাণিজ্যের সুফল ভােগ করতে পারল না। বৃটেন ও ফ্রান্স তাদের জাহাজ গুলােকে জলদস্যুতার কাজে লাগাল। তারা যেখানে জাহাজ পাচ্ছিল সেখানেই স্পেনের জাহাজ মালামালসহ দখল করে নিত। ১৫৭৯ সালে নেদারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলি “নেদারল্যান্ডের যুক্ত প্রদেশ” নামে আবির্ভুত হল, আগে তারা স্পেনের দখলে থাকলেও এখন তারা প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রের কাজ চালাতে লাগল। নেদারল্যান্ড কর্নেলিস ডি হুটম্যান নামে এক অভিযানকারীকে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পাঠাল। এই অভিযান তেমন সফল না হলেও পরবর্তীতে এই অঞ্চলে নেদারল্যান্ডের আধিপত্য বিস্তারে এই অভিযান কাজে লেগেছিল। ১৫৮৮ সালে স্পেনের নৌ বহর “আর্মাদা” ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নৌ অভিযানে নেমে পরাজিত হল। এতে তাদের বাণিজ্যের কর্তৃত্ব অনেকটা খর্ব হল। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ রাজকীয় ফরমান বলে “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্থাপন করেন। নেদারল্যান্ড ও ডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী (Vereengide Oost Indische Compagnie-VOC) স্থাপন করে ১৬০২ সালে। পর্তুগাল, ফ্রান্স, সুইডেনও এদের অনুকরণ করে তাদের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপন করে।
মসলা বাক্স
১৬৭০ সাল নাগাদ নেদারল্যান্ডের VOC পৃথিবীর সব চাইতে বড় কোম্পানী হয়ে দাঁড়াল এবং তাদের শেয়ার মালিকদের ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিতে পারল। মশলা বাণিজ্যে তাদের আধিপত্যের কারণ ছিল এই সময় তাদের নৌ ও সামরিক শক্তি। জায়ফলের বাণিজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে তারা এত উদগ্রীব ছিল যে ইংরেজদের সঙ্গে তারা রুন নামে একটি দ্বীপ বিনিময় করল। রুন ছিল বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার একটি ছােট দ্বীপ যা তখন ছিল জায়ফল উৎপাদনের বড় এলাকা। এটা ছিল ইংল্যান্ডের দখলে। বিনিময়ে তারা ইংল্যান্ডকে নিউ আমষ্টারডাম নামে একটি আমেরিকার দ্বীপ দিল।
পরবর্তীতে এই নিউ আমস্টারডামই নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দ্বীপে পরিণত হয়। ব্যবসায় একছত্র নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার জন্য রুন দ্বীপ সহ বান্দা দ্বীপপুঞ্জের সব প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে VOC হত্যা করেছিল। বান্দা দ্বীপপুঞ্জে আসার ১৫ বৎসর এর মধ্যে এখানকার বাসিন্দাদের সতের ভাগের ষােল ভাগকেই তারা হত্যা করে। জাপান থেকে শ্রমিক ও সৈন্য নিয়ে এসে তারা কাজ চালায়। এর ফলে তারা জায়ফল উৎপাদন ও বাণিজ্যে একক আধিপত্য স্থাপন করে।
লবঙ্গ-র ক্ষেত্রেও VOC একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমবন (Ambon) দ্বীপ ছাড়া আশেপাশের যত দ্বীপ এ লবঙ্গ চাষ হত, সেখানকার সব গাছ তারা ধবংস করল। ১৬৪১ সালে ডাচরা মালয়েশিয়ার মালাক্কা রাজ্য দখল করে। ১৬৫৮ সালে তারা শ্রীলংকার দারুচিনি উৎপাদন ও ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। ১৬৬৩ সালে তারা ভারতের মালাবার উপকূলে গােলমরিচের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ফলে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে এসে পৃথিবীর প্রায় বেশীরভাগ মশলার ব্যবসাই নেদারল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে এই অবস্থা বেশী দিন স্থায়ী হয় নাই। এই সময় ইউরােপের খাবার তৈরীর পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। মশলার ব্যবহার কমে আসে। তাছাড়া বৃটিশ ও ফরাসীরা জায়ফল গাছ আফ্রিকার জাম্বিয়া, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপ গ্রানাডা ও অন্যান্য স্থানে রােপণ করে। এইভাবে নেদারল্যান্ডের কর্তৃত্ব কমতে থাকে। VOC র লাভ কমতে থাকে এবং ১৭৯৯ সালে এই কোম্পানী দেওলিয়া হয়ে যায়। ১৭৮০ সালে VOC ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং ১৮২৪ সালে চুক্তির মাধ্যমে বৃটেন ও নেদারল্যান্ড পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ভাগ করে নেয়।
ঊনবিংশ শতকের শুরুতে মশলা ব্যবসা সম্পূর্ণ বদলে যায়। তিন হাজার বছর ধরে এই ব্যবসার উপর আধিপত্য বিস্তার করা ও ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন রাজ্য ও গােষ্ঠীর প্রচেষ্টার অবসান হয়। তিন হাজার বৎসরে বিভিন্ন শক্তি এই বাণিজ্যের ফলে ধনসম্পদ অর্জন করে। বাণিজ্য ধরে রাখার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ করে, মশলা উৎপাদক দেশগুলিতে অত্যাচার চালায়। তবে ঊনবিংশ শতকের শুরুর পর থেকে মশলা উৎপাদন ও ব্যবসায় আর কারও একাধিপত্য থাকল না।
The Devastating Effects of Colonization on Hawai’i
স্পেনের আমেরিকা বিজয়
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালীর জেনােয়া অঞ্চলের একজন নাবিক। তাঁর আশা ছিল পশ্চিম দিকে যাত্রা করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চীন ও পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌছাবেন। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ তখন ছিল মশলার অন্যতম এলাকা- এটা আগেই বলা হয়েছে। তিনি শেষ পর্যন্ত স্পেনের রাজা ও রানীকে রাজী করাতে পারলেন তাঁর অভিযানে অর্থায়ন করতে। ১৪৯২ সালের ৩রা আগষ্ট তিনি তিনটি জাহাজ নিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলেন, উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ায় পৌছান। পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মশলা সংগ্রহ এই ব্যবসায় ভাগ বসান ছিল লক্ষ্য। পৃথিবী গােল এ বিশ্বাস পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের মিশ্রণে কলম্বাসের হিসাব ছিল ভুল ও পৃথিবীর পরিধি প্রায় ২৫ শতাংশ কম ধরে নিয়েছিলেন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি ছােট দ্বীপে পৌছান, সেখান থেকে আরও দুটি দ্বীপে যান, যেগুলি এখন কিউবা ও হাইতি নামে পরিচিত। তাঁর বিশ্বাস ছিল তিনি পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে গেছেন।
এই দ্বীপগুলির অধিবাসী ছিল এমন মানুষেরা যাদের কোন রাষ্ট্র ছিল না, ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও কোন ধারণা তাদের ছিল না। তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। কলম্বাস নিজে তাদের সম্মন্ধে লিখেছিলেন “পৃথিবীতে এদের চাইতে আরও ভাল মানুষ আছে কিনা-সন্দেহ, এরা এত স্নেহশীল ও উদার” । কিন্তু কলম্বাসের উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ আহরণ। এখানকার অধিবাসীদের ধরে দাসের কাজ করান শুরু করলেন। সামান্য কিছু স্বর্ণালঙ্কার ছিল এদের। এগুলাে তাে জোর করে নেওয়া হলই, এদের নির্যাতন করা হল কোথায় স্বর্ণের উৎস তা জানার জন্য। এর পরের যাত্রায় কলম্বাস আরও লােকজন নিয়ে এসে সাতটি উপনিবেশ স্থাপন করলেন। এবার একটা নিয়ম করা হল, ১৪ বৎসর বয়সের বেশী যারা আদিঅধিবাসী আছে, তাদের প্রত্যেককে তিন মাস পর পর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ স্পেনীয়দের দিতে হবে। তা না হলে তাদের হাত কেটে ফেলা হবে, যাতে তারা রক্তপাত হয়ে মারা যায়। এই বর্বরতার পরও স্বর্ণের দাবী মেটান যায় নাই, কারণ এই দ্বীপগুলিতে বড় স্বর্ণের খনি ছিল না। সব আদিঅধিবাসীকে দাস হিসাবে খাটান শুরু হল। কলম্বাসের এই ব্যবস্থাগুলাের ফলাফল হল মর্মান্তিক। কলম্বাস আসার সময় হিসপানিওয়ালার (বর্তমানে যে দ্বীপে হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক অবস্থিত) জনসংখ্যা ছিল প্রায় দশ লক্ষেরও বেশী, পঞ্চাশ বছর পর ১৫৪২ সালে এই সংখ্যা নেমে দুইশতে আসে। আদিঅধিবাসীরা (যাদের ইন্ডিয়ান নাম দেওয়া হয়েছিল) মারা যাবার পর কাজ স্পেনীয়দেরই করতে হত। তারা যে ধন-সম্পদের লােভে এখানে এসেছিল,তা হতাশায় পরিণত হল। কাজ আদায় করার জন্য তাদের উপর অত্যাচার শুরু হল। তৃতীয় সফরের পর
কলম্বাসকে বন্দী করে স্পেনে ফেরৎ পাঠান হল। কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে চতুর্থবারের মত ফিরে এলে এবারও কোন ফল দেখাতে পারেন নি। স্পেনের রাজা তাকে হিসপানিওয়ালাতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন।
মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো উপত্যকায় ত্রয়ােদশ শতকে আজটেক গােষ্ঠীর মানুষেরা বসতি স্থাপন করে। তারা ছিল শিকারী -সংগ্রাহক, কৃষির অভিজ্ঞতা তাদের খুব বেশী ছিল না। এই উপত্যকায় আগে থেকেই অন্যান্য জনগােষ্ঠীরা বাস করে আসছিল, তারা আজটেকদের সবচাইতে কম উর্বর জমি দিল। আজটেকরা কৃষির কৌশল রপ্ত করে নতুন পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়ান শিখল। ক্রমেই তারা অন্যান্য জাতিগােষ্ঠীকে পদানত করল। এজন্য তাদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন করতে হল। তাদের সমাজে যােদ্ধারাই ছিল সবচাইতে প্রভাবশালী, অন্যান্য শ্রেণী হল নিপীড়িত। তবে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হল শত শত মাইলব্যাপী-দক্ষিণে যা বর্তমান গুয়াতেমালা পর্যন্ত পৌঁছেছিল ।
১৫১৮ সালে হারনান কর্তেজ (Hernan Cortes) নামে একজন স্পেনীয় সৈন্য ৫০০ যােদ্ধা নিয়ে কিউবা থেকে জাহাজে করে মধ্য আমেরিকার উপকূলে আসল। এখানকার ঐশ্বর্যশালী সাম্রাজ্যের খবর তার কাছে পৌছেছিল। আসার পরই সে তার জাহাজগুলিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল, যাতে তার সৈন্যদের আর ফেরার পথ না থাকে। আজটেক রাজা মন্টেজুমা তাদেরকে সমুদ্র উপকূল থেকে মেক্সিকো উপত্যকায় আনার ব্যবস্থা করল। তার সাহায্য ছাড়া আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আসা সম্ভব হত না। কর্তেজ বন্ধুত্বের ভান করে কৌশলে মন্টেজুমাকে বন্দী করল। পরবর্তী দুই বছরে আজটেকদের সৈন্যবাহিনীকে (যা তার সৈন্যদের চাইতে কয়েক শত গুণ বড় ছিল) কর্তেজ পরাস্ত করল। এই সাফল্যের কারণ ছিল কয়েকটি, স্পেনীয়দের ছিল উন্নত অস্ত্র- ইস্পাতের তৈরী, আজটেকদের লােহা বা ইস্পাত ছিল না, স্পেনীয়দের ছিল কামান ও অশ্বারােহী। ঘােড়া আজটেকরা আগে দেখেনি। স্পেনীয়রা গুটি বসন্ত রােগের জীবাণু বহন করে এসেছিল (তাদের অজান্তেই)। যুদ্ধে রাজধানী অবরােধের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আজটেকরা বিরাট সংখ্যায় গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই রােগের বিরুদ্ধে তাদের কোন প্রতিরােধ ক্ষমতা ছিল না। একটা বড় কারণ ছিল আজটেকদের অনৈক্য। অধিকাংশ আজটেক ছিল রাজার দ্বারা নিপীড়িত। তারা স্পেনীয়দের স্বাগত জানিয়েছিল। শেষ যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনীতে আজটেক যােদ্ধার সংখ্যা রাজার বাহিনীর চাইতেও বেশী ছিল।
মেক্সিকো বিজয়ের এক দশক পরে ফ্রান্সিসকো পিজারাে নামে আর একজন স্পেনীয় পানামা থেকে দক্ষিণ দিকে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অনুসরণ করে সমুদ্রযাত্রা করলেন। এর আগে দুইবার তিনি এই অঞ্চলে তথ্য সংগ্রহে এসেছিলেন এবং খবর পেয়েছিলেন যে, মহাদেশের অভ্যন্তরেও একটা বিরাট সাম্রাজ্য আছে। টুমবেজ (Tumbez)। নামে এক উপকূলীয় শহরে তিনি অবতরণ করলেন, সঙ্গে ছিল ১০৬ জন পদাতিক ও ৬২ জন অশ্বারােহী সৈন্য। সেখানে তিনি জানতে পারলেন (বর্তমান) পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যের সিংহাসন নিয়ে দুই ভাইএর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। দুই ভাইএর মধ্যে একজনের (আতাহুয়ালপা) প্রতিনিধিদের সঙ্গে পিজারাে যােগাযােগ করে তাকে সাহায্য করতে চাইলেন। প্রতিনিধিরা তাঁকে কাজামার্কা নামক শহরে নিয়ে গেল দূর্গম পাহাড়ী পথের মধ্য দিয়ে। স্থানীয় ইনকাদের সাহায্য ছাড়া স্পেনীয়দের পক্ষে মহাদেশের অভ্যন্তরে যাওয়া সম্ভব হত না। কাজামার্কা শহরে স্পেনীয়রা তাদের কামান ও অশ্বারােহী বাহিনী চারদিকে স্থাপন করে লুকিয়ে রাখল। এর পরবর্তী ঘটনা পিজারাের ভাই হার্নান্দের বর্ণনায়:“তিনি (আতাহুয়ালপা) আসলেন, তাঁর আগে তিন থেকে চারশত উর্দি পরিহিত ইন্ডিয়ান গান গাইতে গাইতে রাস্তা পরিস্কার করে আসল। তারপর আতাহুয়ালপা তার পারিষদবর্গ নিয়ে আসলেন-তার মধ্যে যারা গুরুত্বপূর্ণ তাদেরকে মানুষরা বহন করে নিয়ে আসল”। এরপর পিজারাের সঙ্গে আসা একজন পাদ্রী আতাহুয়ালপাকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে স্পেনের রাজার প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করার আহ্বান জানাল। পাদ্রী এটাও বলল পােপ আমেরিকার এই অংশ স্পেনকে দিয়েছেন। আতাহুয়ালপা উত্তরে বলেছিলেন, আমি কারও অধীনস্ত হতে রাজী না। আর যে পােপের কথা বলা হচ্ছে, তিনি যে দেশ তার নয়, তা দান করার কথা বলা পাগলের প্রলাপ হবে। এরপর পিজারাের ইঙ্গিতে চারদিকে লুকানাে কামান থেকে গােলাবর্ষণ শুরু হল আর অশ্বারােহী সৈন্যরা আক্রমণ করল। ইনকাদের হিসাব মতে প্রায় দশ হাজার ইনকা মারা যায়। আতাহুয়ালপাকে বন্দী করা
কলম্বাসকে বন্দী করে স্পেনে ফেরৎ পাঠান হল। কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে চতুর্থবারের মত ফিরে এলে এবারও কোন ফল দেখাতে পারেন নি। স্পেনের রাজা তাকে হিসপানিওয়ালাতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন।
মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো উপত্যকায় ত্রয়ােদশ শতকে আজটেক গােষ্ঠীর মানুষেরা বসতি স্থাপন করে। তারা ছিল শিকারী -সংগ্রাহক, কৃষির অভিজ্ঞতা তাদের খুব বেশী ছিল না। এই উপত্যকায় আগে থেকেই অন্যান্য জনগােষ্ঠীরা বাস করে আসছিল, তারা আজটেকদের সবচাইতে কম উর্বর জমি দিল। আজটেকরা কৃষির কৌশল রপ্ত করে নতুন পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়ান শিখল। ক্রমেই তারা অন্যান্য জাতিগােষ্ঠীকে পদানত করল। এজন্য তাদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন করতে হল। তাদের সমাজে যােদ্ধারাই ছিল সবচাইতে প্রভাবশালী, অন্যান্য শ্রেণী হল নিপীড়িত। তবে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হল শত শত মাইলব্যাপী-দক্ষিণে যা বর্তমান গুয়াতেমালা পর্যন্ত পৌঁছেছিল ।
১৫১৮ সালে হারনান কর্তেজ (Hernan Cortes) নামে একজন স্পেনীয় সৈন্য ৫০০ যােদ্ধা নিয়ে কিউবা থেকে জাহাজে করে মধ্য আমেরিকার উপকূলে আসল। এখানকার ঐশ্বর্যশালী সাম্রাজ্যের খবর তার কাছে পৌছেছিল। আসার পরই সে তার জাহাজগুলিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল, যাতে তার সৈন্যদের আর ফেরার পথ না থাকে। আজটেক রাজা মন্টেজুমা তাদেরকে সমুদ্র উপকূল থেকে মেক্সিকো উপত্যকায় আনার ব্যবস্থা করল। তার সাহায্য ছাড়া আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আসা সম্ভব হত না। কর্তেজ বন্ধুত্বের ভান করে কৌশলে মন্টেজুমাকে বন্দী করল। পরবর্তী দুই বছরে আজটেকদের সৈন্যবাহিনীকে (যা তার সৈন্যদের চাইতে কয়েক শত গুণ বড় ছিল) কর্তেজ পরাস্ত করল। এই সাফল্যের কারণ ছিল কয়েকটি, স্পেনীয়দের ছিল উন্নত অস্ত্র- ইস্পাতের তৈরী, আজটেকদের লােহা বা ইস্পাত ছিল না, স্পেনীয়দের ছিল কামান ও অশ্বারােহী। ঘােড়া আজটেকরা আগে দেখেনি। স্পেনীয়রা গুটি বসন্ত রােগের জীবাণু বহন করে এসেছিল (তাদের অজান্তেই)। যুদ্ধে রাজধানী অবরােধের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আজটেকরা বিরাট সংখ্যায় গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই রােগের বিরুদ্ধে তাদের কোন প্রতিরােধ ক্ষমতা ছিল না। একটা বড় কারণ ছিল আজটেকদের অনৈক্য। অধিকাংশ আজটেক ছিল রাজার দ্বারা নিপীড়িত। তারা স্পেনীয়দের স্বাগত জানিয়েছিল। শেষ যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনীতে আজটেক যােদ্ধার সংখ্যা রাজার বাহিনীর চাইতেও বেশী ছিল।
মেক্সিকো বিজয়ের এক দশক পরে ফ্রান্সিসকো পিজারাে নামে আর একজন স্পেনীয় পানামা থেকে দক্ষিণ দিকে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অনুসরণ করে সমুদ্রযাত্রা করলেন। এর আগে দুইবার তিনি এই অঞ্চলে তথ্য সংগ্রহে এসেছিলেন এবং খবর পেয়েছিলেন যে, মহাদেশের অভ্যন্তরেও একটা বিরাট সাম্রাজ্য আছে। টুমবেজ (Tumbez)। নামে এক উপকূলীয় শহরে তিনি অবতরণ করলেন, সঙ্গে ছিল ১০৬ জন পদাতিক ও ৬২ জন অশ্বারােহী সৈন্য। সেখানে তিনি জানতে পারলেন (বর্তমান) পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যের সিংহাসন নিয়ে দুই ভাইএর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। দুই ভাইএর মধ্যে একজনের (আতাহুয়ালপা) প্রতিনিধিদের সঙ্গে পিজারাে যােগাযােগ করে তাকে সাহায্য করতে চাইলেন। প্রতিনিধিরা তাঁকে কাজামার্কা নামক শহরে নিয়ে গেল দূর্গম পাহাড়ী পথের মধ্য দিয়ে। স্থানীয় ইনকাদের সাহায্য ছাড়া স্পেনীয়দের পক্ষে মহাদেশের অভ্যন্তরে যাওয়া সম্ভব হত না। কাজামার্কা শহরে স্পেনীয়রা তাদের কামান ও অশ্বারােহী বাহিনী চারদিকে স্থাপন করে লুকিয়ে রাখল। এর পরবর্তী ঘটনা পিজারাের ভাই হার্নান্দের বর্ণনায়:“তিনি (আতাহুয়ালপা) আসলেন, তাঁর আগে তিন থেকে চারশত উর্দি পরিহিত ইন্ডিয়ান গান গাইতে গাইতে রাস্তা পরিস্কার করে আসল। তারপর আতাহুয়ালপা তার পারিষদবর্গ নিয়ে আসলেন-তার মধ্যে যারা গুরুত্বপূর্ণ তাদেরকে মানুষরা বহন করে নিয়ে আসল”। এরপর পিজারাের সঙ্গে আসা একজন পাদ্রী আতাহুয়ালপাকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে স্পেনের রাজার প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করার আহ্বান জানাল। পাদ্রী এটাও বলল পােপ আমেরিকার এই অংশ স্পেনকে দিয়েছেন। আতাহুয়ালপা উত্তরে বলেছিলেন, আমি কারও অধীনস্ত হতে রাজী না। আর যে পােপের কথা বলা হচ্ছে, তিনি যে দেশ তার নয়, তা দান করার কথা বলা পাগলের প্রলাপ হবে। এরপর পিজারাের ইঙ্গিতে চারদিকে লুকানাে কামান থেকে গােলাবর্ষণ শুরু হল আর অশ্বারােহী সৈন্যরা আক্রমণ করল। ইনকাদের হিসাব মতে প্রায় দশ হাজার ইনকা মারা যায়। আতাহুয়ালপাকে বন্দী করা
The-Capitol-stands-in-the-background-of-this-1830-engraving.
Credit Library-of-Congress
দাস ব্যবসা
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরােপের সম্পদের একটা বড় অংশ এসেছিল দাস-ব্যবসা থেকে। এই ব্যবসায় অস্ত্রের মুখে হাজার হাজার পশ্চিম আফ্রিকাবাসীকে জোর করে ধরে নিয়ে জাহাজে তুলে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে আমেরিকায় নেওয়া হত। এই যাত্রা হত অত্যন্ত শােচনীয় পরিবেশে-প্রতি দশ জনে একজন পথেই মারা যেত। তাদেরকে আমেরিকায় নীলামে বিক্রি করা হত। তারপর তারা সারাজীবন বিনা পারিশ্রমিকে তার মালিকের কাজ করত প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা-অনেক সময় চাবুক দিয়ে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হত। কমপক্ষে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই পরিণতি ভােগ করেছে। প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ সমুদ্রযাত্রায় মারা যায়। একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, ১৮২০ সাল নাগাদ প্রায় ১ কোটি আফ্রিকানকে আমেরিকায় আনা হল, ইউরােপ থেকে আসল ২০ লাখ। কিন্তু আমেরিকায় ইউরােপীয়ান বংশােদ্ভূতদের সংখ্যা হল ১ কোটি ২০ লাখ- আফ্রিকান বংশােদ্ভূতদের প্রায় দুই গুণ।
স্পেনীয়রা আমেরিকা জয় করার পর আদিবাসী “ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করে তা বলা হয়েছে। তার উপর ছিলইউরােপ থেকে নিয়ে আসা সংক্রামক রােগের মহামারী- আদিবাসীদের জনসংখ্যা ৯০ শতাংশ কমে গেল। কাজ করার লােকের অভাব পূরণ করার জন্য আফ্রিকার দাস কিনে নিয়ে আসা শুরু হল। দাস ব্যবসা বড় আকার ধারণ করল পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যখন তাদের উপনিবেশগুলিতে তামাক ও ইক্ষু চাষ শুরু করল। তামাক ও ইক্ষু চাষে অনেক শ্রমিক লাগত। যতই তামাক ও চিনির বাজার বাড়তে থাকল, ততই শ্রমিকের দরকার বাড়ল, আর অধিক সংখ্যায় আফ্রিকা থেকে দাস আনা হতে থাকল।
প্রাচীন যুগে বা মধ্যযুগে মানুষ চামড়ার রং মানুষকে বড় বা ছােট করে এটা মনে করত না। এটা মানুষের ওজন বা উচ্চতার পার্থক্যের মতই একটা বৈশিষ্ট্য মনে করত। আফ্রিকা হতে আনা দাসদের সঙ্গে মিলে অন্যান্য শ্রমিকেরা বিদ্রোহ করা শুরু করল, ছােট জমির সাদা চামড়ার মালিকেরা যাদের দাস ছিল না, তারাও বড় ভূস্বামীদের প্রতি বিদ্বেষবশত: দাসদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরােপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা আমেরিকার আদিবাসীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরােধে লিপ্ত হল। এই সমস্ত কারণে বিত্তশালী ও বড় ভূস্বামীরা আফ্রিকার বংশােদ্ভূত দাস আর আদিবাসীদের সম্মন্ধে অন্যান্য সাদা মানুষদের ঘৃণা ও ভীতি সৃষ্টির প্রয়ােজন অনুভব করল। কৃষ্ণবর্ণ দাসদের জন্মগতভাবে শ্বেতাঙ্গদের চাইতে নিকৃষ্ট বলে প্রচারণা করা হল। আদিবাসীদের বলা হল বর্বর, মানুষখেকো। কিন্তু যে সমস্ত ইউরােপীয় বংশােদ্ভূত লােক ১৫২০ ও ১৫৩০ এর দশকে মেক্সিকোর আজটেক সভ্যতা ও পেরুর ইনকা সভ্যতা দেখেছিল, তারা এই সভ্যতাগুলির ঐশ্বর্য ও অর্জন দেখে অভিভূত হয়েছিল। টেনকটিটলান (Tenochtitlan) নামে আজটেক শহর ইউরােপের যে কোন শহরের সমমানের ছিল। ইনকাদের রাজধানী কুজকো ৩০০০ মাইল দীর্ঘ সড়কপথ দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের সাথে যুক্ত ছিল। সারা ইউরােপে কোথাও এমন ছিল না। তাদের কৃষিতে সেচ পদ্ধতি ছিল অভিনব । অঙ্কশাস্ত্রেও তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। ক্রমেই বহু দশক ধরে বর্ণবাদ পশ্চিমা বিশ্বে বিশ্বাসে পরিণত হল।
পুঁজিবাদের উত্থানে উপনিবেশবাদ ও দাস ব্যবসার একক অবদান ছিল তা অনেকেই মনে করেন না। কিন্তু এদুটোর ভূমিকা যে উল্লেখযােগ্য ছিল তা অস্বীকার করা যাবে না। পশ্চিম ইউরােপ বিশেষত: বৃটেনের অর্থনীতিতে এদুটোর প্রভাব ছিল বিরাট। প্রক্রিয়াটি “ত্রিমুখী বাণিজ্য” নামে অভিহিত হয়েছে। আফ্রিকায় ইউরােপীয় অস্ত্র, লােহার জিনিষপত্র ও কাপড়ের বিনিময়ে দাস সংগ্রহ করত। দাসদের আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ে বিক্রি করা হত। সেই অর্থ দিয়ে তামাক, চিনি এবং পরবর্তীতে তুলা কিনে ইউরােপে নিয়ে এসে লাভে বিক্রি করা হত। বাণিজ্যে সমুদ্রযাত্রার প্রয়ােজনে জাহাজ তৈরী ও মেরামত দরকার হত। এতে জাহাজ শিল্প হল সমৃদ্ধ। কার্ল মার্কস উপনিবেশবাদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আদি পুঁজির সঞ্চয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন ‘১২ ডেভিস স্বীকার করেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যে ভিত্তি তৈরী করে তা না থাকলে শিল্প বিপ্লব
এত দ্রুত হত কিনা সন্দেহ। হবসবম বলেছেন, আমাদের শিল্প সমৃদ্ধ অর্থনীতি কম উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
এশিয়ায় সাম্রাজ্য
এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার
পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ইউরােপের বাণিজ্য প্রথমদিকে ছিল প্রধানত: স্থলপথে মধ্য এশিয়ার পথ দিয়ে পশ্চিম এশিয়া ও কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলি থেকে ইউরােপে মালপত্র আসত। পঞ্চদশ শতকের আগে নৌপথে ইউরােপের জাহাজগুলি মরক্কোর পর আর যেত না। পঞ্চদশ শতকে এটা বদলে গেল। জাহাজের উন্নত গঠন প্রণালী ও নতুন জাহাজ চালনার প্রযুক্তি আরও দূরপাল্লার সমুদ্রযাত্রা সহজতর করল। এ ব্যাপারে পর্তুগীজরা ছিল অগ্রণী। ১৩৮৫ সালের পর পর্তুগাল একদেশে পরিণত হয়। এরপর সে দেশে আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল না। ভূমধ্যসাগর সে সময় ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র। ভূমধ্যসাগরে যেতে না পারায় পর্তুগীজদের আটলান্টিক মহাসাগরে দৃষ্টি দিতে হল। আটলান্টিক ছিল পর্তুগীজদের মাছ ধরার ক্ষেত্র আর দূর পাল্লার নৌ-বাণিজ্যের সমুদ্র। এশিয়ার মূল্যবান জিনিষপত্রের (যেমন মশলা, রেশম বস্ত্র, সূতী বস্ত্র, চীনা মাটির দ্রব্যাদি ইত্যাদি) ইউরােপে উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে চাহিদা ছিল। এই বাণিজ্য ছিল লাভজনক এবং এটা আরব বণিক ও ইতালীয় বণিকরা নিয়ন্ত্রণ করত। বিশেষত: মশলার ব্যবসা ছিল আকর্ষণীয়- এটা আগেই বলা হয়েছে। এই ব্যবসায় অংশ নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে এবং রাজ-প্রশাসনের সহযােগিতা নিয়ে পর্তুগীজরা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে এগােতে থাকে। তারা এই অঞ্চলে এজোর্স, মাদিরা ইত্যাদি দ্বীপ আবিস্কার করে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। ১৯৮৮ সালে তারা আফ্রিকার দক্ষিনাঞ্চল উত্তমাশা অন্তরীপে পৌছায়। ১৪৯৮ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ভাস্কো-ডা-গামা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌছেন। এরপর পর্তুগীজরা আরও পূর্বদিকে বর্তমান শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও জাপান পৌছে। তারা এইসব এলাকায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। এশিয়ার মূল্যবান পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ে পর্তুগীজদের দেওয়ার কিছু না থাকায় তারা বলপ্রয়ােগ ও লুটপাটের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ করল। রেশমবস্ত্র, হাতির দাঁত, বিশেষতঃ গােল মরিচ ইউরােপে নিয়ে বিক্রি করে লাভ করল। এর আগে যে পথে এইসব পণ্যদ্রব্য যেত (যেমন নিকট প্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল), সেই পথ কিছুকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। পর্তুগালের রাজকোষ সমৃদ্ধ হল। পর্তুগীজ রাজা তার বণিকদের ব্যবসা একচেটিয়া রাখার জন্য সমস্ত এশিয়ার বাণিজ্য তার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করল। সব ব্যবসায়ীকে পর্তুগীজ রাজার কাছ থেকে সনদ নিতে হত ও কর দিতে হত। এই ব্যবস্থা চালানর মত সামরিক শক্তি ও সম্পদ পর্তুগালের ক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৫৩০ এর দশকের পর থেকেই ইউরােপের অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা এই আইন ভেঙ্গে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে ব্যবসা শুরু করল। এশিয়াতেও ব্যবসায়ীরা পর্তুগীজদের জাহাজের চাইতে ছােট কিন্তু দ্রুতগামী জাহাজে পর্তুগীজদের এড়িয়ে ব্যবসা শুরু করল । ১৫৬০ সাল নাগাদ পর্তুগীজ অবরােধ ভেঙ্গে ভূমধ্যসাগর দিয়ে আবার মশলা ইউরােপে আসা শুরু করল। কিন্তু অবরােধ কার্যকর রাখার জন্য যে খরচ তা ছিল অনেক। ১৫২৪ সাল থেকেই পর্তুগীজ রাজা খরচ চালানর জন্য ধার করা শুরু করলেন এবং ক্রমেই তা বাড়তে থাকল। পর্তুগালের অনেক মানুষ ব্রাজিলে গিয়ে বসতি স্থাপন করায় জনবল কমে গেল। গ্রামাঞ্চলে কৃষি হল অবহেলিত। এই অবস্থায় ১৫৭৮ সালে রাজা মরক্কোর অভিযানে গিয়ে সাত হাজার সৈন্যসহ নিহত হলেন। তার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না। স্পেনের রাজা আত্মীয়তার সূত্রধরে সিংহাসন দাবী করলেন ও পর্তুগালের অভিজাত শ্ৰেণীদের বশ করে সিংহাসন অধিকার করলেন। পর্তুগালের জন্য এটা হল বিপর্যয়। স্পেনের শত্রু ছিল হল্যান্ড। এর আগে ডাচ ব্যবসায়ীরা লিসবনে মশলা কিনতে আসত। স্পেনের রাজা তাদের নিষিদ্ধ করে দিলেন। ডাচরা তাদের সংখ্যাধিক্য ও নৌশক্তির বলে পরবর্তী চল্লিশ বছরে এশিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে পর্তুগীজ সাম্রাজ্য দখল করে নিল। ১৬৪০ সালে পর্তুগীজরা আবার স্বাধীন হল ও ডাচদের সঙ্গে সন্ধি করল। কিন্তু ততদিনে অল্প কয়েকটি জায়গা ছাড়া সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে গেছে।
ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে স্পেন ছিল ইউরােপের সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এছাড়া ষষ্ঠদশ শতকের প্রথমদিকে স্পেনের রাজা চার্লস অন্যান্য ইউরােপীয় রাজাদের মৃত্যুর কারণে ঘটনাচক্রে আত্মীয়তার সূত্র ধরে স্পেন ও স্পেনের আমেরিকার রাজত্ব ছাড়াও বারগান্ডী, অষ্ট্ৰীয়া, ইতালীর একটা বড় অংশ, নিম্ন ভূমির দেশ (Low Countries) এগুলাের রাজত্বও পেলেন। এছাড়াও তাঁকে পােপ নির্বাচিত করা হল। বিপুল সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে তাঁর সম্পদ নি:শেষ হতে লাগল। আমেরিকা থেকে আসা স্বর্ণ, রৌপ্যও খরচ হয়ে গেল। জার্মানীতে রাজা যুদ্ধ করতে বাধ্য হলেন, পূর্বদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হল। রাজকোষ খরচ মেটাতে না পারায় অন্যান্য দেশে প্রচুর দেনা করতে হল। দেনা সময়মত শােধ করতে না পারায় ১৫৫৭ থেকে ১৬৪৭ সাল পর্যন্ত ছয়বার দেওলিয়া ঘােষণা করে খাতকদের হাত থেকে বাঁচতে হল। প্রতিবার দেওলিয়া হবার পর ধার নিতে গেলে সুদের হারও অনেক বেশী হল। সাধারণ মানুষের উপর করের বােঝা বাড়ল, কৃষির অবনতি হল।১৬
সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক থেকেই পর্তুগীজ শক্তির পতনের পর এই স্থান দখল করে ডাচরা। ডাচদের মূল লক্ষ্য ছিল মশলার দ্বীপ মলুক্কা (Molucca) (বর্তমান ইন্দোনেশিয়াতে অবস্থিত)। ডাচরা ইউনাইটেড ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্থাপন করে তার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করল, কোম্পানীর লােকেরা স্থানীয় শাসকদের সহযােগিতায় ব্যবসা চালাতে লাগল। ১৬০৯ সালে বাটাভিয়ায় প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হল (বর্তমান জাকার্তা)। ডাচরাও তাদের কর্মকান্ডে নিষ্ঠুরতার প্রমাণ রেখে গেছে- যেমন স্থানীয় অধিবাসীদের দাস হিসাবে কাজ করান, বিদ্রোহ দমনে হত্যা করা ইত্যাদি। প্রতিযােগিতা বন্ধ করার জন্য তারা স্থানীয়দের এবং চীনাদের জাহাজ ধ্বংস করে। মশলার ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক। প্রায় একশত বছর ধরে আমস্টারডামে পাঠান পণ্যের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই ছিল মশলা।১৭ ডাচরা তাইওয়ান ও জাপানেও পর্তুগীজদের ব্যবসা নিয়ে নিল। তারা শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কালিকটেও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হল। ইংল্যান্ডের নৌশক্তি বাড়লে তারা এই অঞ্চলে ডাচদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় নেমে পেরে উঠল না। ফলে ১৭০০ সাল নাগাদ তারা মশলার ব্যবসার চেষ্টা না করে ভারতে ব্যবসায় নিয়ােজিত হল। বৃটেনের ইতিহাসে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
Mural-Quit-India-movement-Beohar-Rammanohar-Sinha-1952
ভারত অধিকার
ভারতে বৃটিশদের প্রতিযােগী ছিল ফরাসীরা। বৃটিশরা ভারতে প্রভাব বিস্তার করে ধীরে ধীরে। প্রথম তারা মাদ্রাজে ফোর্ট সেন্ট জর্জ স্থাপন করে। এরপর তারা পর্তুগীজ রাজার কাছ থেকে বৃটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়েতে যৌতুক হিসাবে বােম্বাই পায়। এখান থেকে তারা সূতীবস্ত্র ও কফির ব্যবসা চালাতে থাকে। ১৭০০ সালে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পরিচালকরা ভারতে নতুন এলাকা নেওয়ার চেষ্টার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু ১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর প্রেক্ষাপট বদলে যায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসনকাজ চালান শুরু করেন। স্থানীয় বণিকদের সঙ্গে বিদেশী বণিকদের যােগাযােগ ছিল। স্থানীয় বণিকেরা এই সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার অভাব বােধ করছিল। বৃটিশরা এই সুযােগ নিল।
অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে অগ্রসর ছিল। ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সমমানের ছিল। এদেশে উন্নতমানের তাঁতবস্ত্র “মসলিন” তৈরী করা হত ও রপ্তানী করা হত। সেই সময় বৃটিশদের পূর্বপুরুষরা প্রায় আদিম জীবন যাপন করত। বাংলাদেশ ছিল মােগল সামাজ্যের সবচাইতে সম্পদশালী অংশ- তার ধনসম্পদ ইউরােপীয়দের ধাধা লাগিয়ে দিয়েছিল। বৃটিশরা যখন ভারত অধিকার করে তখন শিল্পের উন্নতির দিক দিয়ে ইংল্যান্ডের সমমানের ছিল। বাংলা প্রদেশ অধিকার যিনি করেছিলেন, লর্ড ক্লাইভ, তিনি লিখেন, বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্র ঢাকা ১৭৫৭ সালে ছিল লন্ডন শহরের মতই বড়, জনবহুল ও ধনশালী।২২ বাংলার শাসকশ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে ১৭৫৭ সালের ২২শে জুন ক্ষুদ্র বৃটিশ বাহিনী প্রায় বিনা যুদ্ধেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরাট
বাহিনীকে পরাজিত করল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধই বৃটিশদের ভারতে প্রবেশের রাস্তা খুলে দেয়। এই প্রদেশের ধনসম্পদই বৃটেনকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল অধিকার করার ক্ষমতা দেয়। বৃটেনের ভারত শাসনই বিশ্ব পুঁজিবাদের অগ্রগতির ধারা নির্ধারণ করে। ১৭৬৫ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মােগল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের ভার পায়। কর আদায়ের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়। মানুষ অত্যাচারে কাজকর্ম ফেলে লােকালয় ত্যাগ করে। ১৭৬৯-৭০ সালে (বাংলা সন ১১৭৬) এ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর” নামে পরিচিত। অথচ ১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস কোম্পানীর পরিচালকদের কাছে লিখেন, বাংলাদেশের ব্যাপক মানুষের মৃত্যু এবং তার ফল স্বরূপ কৃষির চরম অবনতি সত্ত্বেও ১৭৭১ সালে নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ সালের রাজস্বের চেয়েও বেশী হয়েছে। এরপর আরও কয়েকটি দুর্ভিক্ষ হয়।
১৮৪০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা দেড়লক্ষ থেকে কমে ত্রিশ হাজার হয়। বৃটিশ হাউস অব লর্ডসে স্যার চার্লস ট্রেভেলিয়ন (একজন বৃটিশ সরকারী কর্মকর্তা, যিনি পরবর্তীতে বৃটিশ ভারতের অর্থমন্ত্রীও হয়েছিলেন) সাক্ষ্য দেন, বাংলা অঞ্চলে গ্রাম জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।২৩ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলায় “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” নামে ভূমি পরিচালনা ব্যবস্থা চালু করেছিল ১৭৯৩ সালে। ব্যক্তিমালিকানায় জমির কর আদায়ের ব্যবস্থা করায় বৃটিশ শাসক ও তার দেশীয় সহযােগিরা প্রভূত লাভবান হলেও দেশের বহুল সংখ্যক নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল-এটা ১৮৩২ সালে বৃটিশ তদন্ত কমিশনের রিপাের্টে বলা হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পরিচালক স্বীকার করেন এই দুর্ভোগের কোন তুলনা পৃথিবীর ব্যবসার ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বাংলার তাঁতীদের হাড় মাঠে ঘাটে শুকাচ্ছে।২৪ তবে বৃটিশরা লাভবান হয়েছিল। গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক বলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যদিও অনেক দিক। দিয়ে বিফল, কিন্তু একটা বড় জমিদার শ্ৰেণী তৈরী করেছে, যাদের জনসাধারণের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে এবং যারা বৃটিশ শাসন বজায় রাখতে সক্রিয়। উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা এই পদ্ধতি পরবর্তীতে আরও অনেক দেশে কাজে লাগিয়েছে।
ভারতের ব্যবসায়ীরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের প্রথম পর্যায়ে এটাকে স্বাগত জানিয়ে সহযােগিতা করেছে। কারণ কোম্পানী তাদের কাছ থেকে অধিক পরিমাণে পণ্যদ্রব্য (মূলত সুতীবস্ত্র) কিনত আর তাদের সম্পদ সুরক্ষা করত। ক্রমেই ভারতের অন্যান্য রাজ্য বৃটিশরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসল। কোন কোন স্থানে তারা যুদ্ধে স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করল, আর কোন কোন স্থানে তাদের অসম চুক্তি করতে বাধ্য করল (যাতে রাজা নামে মাত্র শাসনকর্তা থাকল)। ১৮৫০ সাল নাগাদ প্রায় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। মারাঠাদের পরাজিত করা হল ১৮১৮ সালে, সিন্ধু জয় করা হল ১৮৪৩ সালে, শিখরা পরাজিত হল ১৮৪৯ সালে, আর অযােধ্যা জয় করা হল ১৮৫৬ সালে। রােমান শাসকদের ভাগ করাে ও শাসন করাে (Divide and Rule) এই নীতি প্রয়ােগ করে একজন শাসককে আরেকজনের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে, কোন কোন স্থানে উৎকোচ দিয়ে একশ্রেণীর বিরুদ্ধে আর এক শ্রেণীকে ব্যবহার করে এবং এক ধর্মাবলম্বী মানুষদের আরেক ধর্মাবলম্বী মানুষদের বিরুদ্ধে উম্মাদনার সৃষ্টি করে তারা নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে চলল। বৃটিশরা ২০ কোটি মানুষকে তাদের ৪০ হাজার সৈন্য (এবং তার সঙ্গে তাদের অধীন ২ লক্ষ দেশীয় সৈন্য) দিয়ে জয় করল।২৫
বিপুল ঐশ্বর্য ভারত থেকে বৃটেনে যেতে শুরু করল। এর বেশীরভাগই এদেশের কৃষকের শ্রমলব্ধ অর্থ। প্রতি বছর বৃটেনে ২০ লক্ষ পাউন্ড এর কাছাকাছি অর্থ পাঠান হচ্ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তা বৎসরে ২ কোটি থেকে ৩ কোটি পাউন্ডে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগতভাবেও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মকর্তারা ধনসম্পদ অর্জন করেছিল। ক্লাইভ ২ লক্ষ ৩৪ হাজার পাউন্ড (মূলত লুটপাট করে অর্জন করা) নিয়ে যান ফিরে যাবার সময়। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস এর বড় বড় উৎকোচ নেওয়ার খ্যাতি সুবিদিত।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সন্তষ্ট থাকলেও তাদের ব্যবসা বা শিল্প নীতির উপর কোন প্রভাব ছিল না। নিয়ন্ত্রণ ছিল কোম্পানীর সদর দফতর ইংল্যান্ডের। উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে এটা পরিস্কারভাবে দেখা গেল, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতের সুতীবস্ত্র ইংল্যান্ডে বাজারজাত করে কোম্পানী লাভ করত। উনবিংশ শতকে যান্ত্রিক তাঁতের দ্বারা অধিক পরিমাণে ও কমদামে বস্ত্র তৈরী করা শুরু হল বৃটেনে। বৃটেনের সুতীবস্ত্র ভারতের বাজার দখল করে নিল। ভারতের লক্ষ লক্ষ তাঁতী সর্বস্বান্ত হল, ভারতের ব্যবসায়ীরা হল ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়া ব্যাংক ব্যবসা, জাহাজ তৈরী শিল্প ইত্যাদি দেশীয় ব্যবসায়ীদের হাতছাড়া হয়ে গেল। ভারতের শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে গেল, কিন্তু নীতি নির্ধারণে এদেশের ব্যবসায়ীদের কোন ভূমিকা না থাকায় তারা দেশের স্বার্থ ও নিজেদেরও স্বার্থরক্ষা করতে পারল না।
উনবিংশ শতাব্দী নাগাদ ভারতের রপ্তানী অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বৃটেনের বাণিজ্য ঘাটতির দুই পঞ্চমাংশ পূরণ করা হচ্ছিল। ভারতের জাতীয় আয়ের এক তৃতীয়াংশের অধিক কোন না কোনভাবে বৃটেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ভারতের মানুষের প্রদত্ত কর দিয়ে বৃটিশ সেনাবাহিনী পালন হচ্ছিল তাই নয়, এই সেনাবাহিনীকে বৃটেনের প্রয়ােজনে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছিল। বৃটেনের উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া বাজার হিসাবে ভারতকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভারতে উৎপাদিত আফিম চীনে বাজারজাত করা হচ্ছিল।
The British bombardment of Guangzhou
চীনে প্রভাব বিস্তার
১৭৯৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ এর দূত হিসাবে লর্ড ম্যাকার্টনী চীনের রাজদরবারে এসে পারস্পরিক কূটনৈতিক সমতা এবং মুক্ত বাণিজ্য সুবিধা প্রার্থনা করলেন। চীনের সম্রাট এটা প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাট তার বক্তব্যে ইংল্যান্ডের কথা উল্লেখ করে বল্লেন, “আপনাদের সুদূর দ্বীপ, যা নিস্ফলা, সমুদ্র দ্বারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, তবে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন “আনুগত্য দেখিয়ে উপহার পাঠানর জন্য এবং ভবিষ্যতে আরও ভক্তি ও বিশ্বস্ততা দেখানর উপদেশ দিলেন। ২৮ এই আচরণ শুধু যে ঔদ্ধত্য ছিল তা নয়। এটা তৎকালীন চীনের উচ্চশ্রেণীর তাদের সভ্যতা ও সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস এর বহি:প্রকাশ ছিল। এটা একশত বছর পর ইউরােপীয় ও আমেরিকানদের মধ্যে দেখা গেছে পৃথিবীর অন্যান্য মানুষদের সম্বন্ধে। চীনারা মনে করত তাদের সভ্যতাই শ্রেষ্ঠ, বস্তুগত, কৌশলগত দক্ষতা তাদের সবই আছে, বাইরে থেকে তেমন কিছু আনার দরকার নাই। যেটুকু বাণিজ্য ক্যান্টনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে হচ্ছে ( প্রায় এক হাজার ইউরােপীয় তখন সেখানে ছিল) তা যথেষ্ট। এটা মনে করার কারণও ছিল। এর আগে কয়েক শতকের বাণিজ্যে চীনারা ইউরােপে তৈরী এমন কিছু পায় নাই যা তাদের দরকার । চীনাদের সঙ্গে বাণিজ্যে ইউরােপীয়দের তাই হয় রূপা দিতে হত, অথবা এশিয়ার অন্য দেশ থেকে আনা পণ্য দিতে হত।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যে বৃটিশরা এমন একটা জিনিষ খুঁজে বের করল, যা চীনে বিক্রি করা যায়; তা হল আফিম। এই সময় বৃটেন চীন থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকা পরিমাণে চা কিনছিল রূপার বিনিময়ে। ভারতে বিশাল এলাকায় তারা অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন বন্ধ করে আফিমের চাষ শুরু করল। এটা তারা চীনে বিক্রি করা শুরু করল। ১৮১০ সাল নাগাদ ৩ লক্ষ ২৫ হাজার কিলােগ্রাম আফিম তারা বৎসরে চীনে বিক্রি করছিল। ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় চীনারা যখন নেশাগ্রস্ত হতে শুরু করল, তখন চীনের কর্তৃপক্ষ এটা বন্ধ করার চেষ্টা করল। তারা গুদামে রক্ষিত আফিম বাজেয়াপ্ত করা ও গুদাম বন্ধ করা শুরু করল ১৮৩০ এর দশকের শেষদিকে। চীনের মানুষকে নেশাগ্রস্ত করার অধিকার রক্ষা করার জন্য বৃটেন যুদ্ধ শুরু করল।
১৮৪০ সালের জুন মাসে বৃটিশ যুদ্ধ জাহাজ ক্যান্টন নদীর মােহনায় উপস্থিত হল। সাংহাই এর পতনের পর নানকিংএ হামলা শুরু হওয়ার পর ১৮৪২ সালে চীন পরাজয় স্বীকার করল। এভাবে শেষ হল প্রথম আফিম যুদ্ধ। নানকিংএ চুক্তি হল। চীন হংকং বৃটেনকে দিতে বাধ্য হল, চীনের পাঁচটি বন্দরে বাণিজ্য করা ও স্থায়ীভাবে থাকার অধিকার দিল বৃটিশদের,
পণ্যদ্রব্যের উপর শুল্ক কমান হল। আর বৃটিশ নাগরিকদের চীনা আদালতে বিচার করা যাবে না এটা মানতে হল। অন্যান্য দেশ সুযােগ পেয়ে চাপ দিয়ে একই ধরনের চুক্তি করতে বাধ্য করল। আমেরিকা, রাশিয়া ও ফ্রান্স এটা করল।
তবে চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশের অধিকার চীন তখনও দেয়নি। দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক সামাজিক গঠন বদল না হওয়ায় বিদেশী পণ্যের চাহিদা বাড়ছিল না। চীনের আঞ্চলিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি (যা ভারতের মত ভেঙ্গে দেওয়া হয়নি) বিদেশী পণ্যের অনুকূল ছিল না। বৃটিশ বণিকেরা তাই আফিম চোরাচালান করতেই থাকল। এর বিনিময়ে চীন থেকে রূপা বাইরে পাচার হতে থাকল। রূপা চীনে মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার হত। চীনের কম উর্বর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অবস্থার অবনতি হল। চীনের কৃষকরা বিদ্রোহ করল। এই বিদ্রোহ “তাইপিং” বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্রোহ শুরু হয়ে ১৮৫৩ সাল নাগাদ চীনের প্রায় অর্ধেক এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেল। এই বিদ্রোহে যদিও চীনের সমাজ ব্যবস্থা আধুনিক করার দাবিই উঠেছিল, কিন্তু বিদেশী শক্তিগুলি তাদের সুযােগ সুবিধা খর্ব হবে এই আশঙ্কা করছিল। তাই বিদেশী শক্তি বিশেষত: বৃটেন ও ফ্রান্স চীনের সম্রাটকে সাহায্য করল তার সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করতে এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত করতে। ১৮৬৪ সালে বিদ্রোহীদের কেন্দ্র নানকিং শহরের পতন হল। প্রায় এক লক্ষ বিদ্রোহী নিহত হল।
এর আগেই ১৮৫৬ সালে বৃটেন ও ফ্রান্স চীনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু করেছিল। বিদ্রোহের ফলে চীনের সম্রাট আরও দুর্বল হয়ে গেল এবং বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরতা বাড়ল, বিদেশীরা চীনকে আরও সুবিধা দিতে বাধ্য করল। আরও কয়েকটা বন্দরে বাণিজ্য করার সুযােগ, দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্য করার সুযােগ, ইয়াংসি নদীতে টহল দেওয়ার অধিকার ইত্যাদি তারা আদায় করে নিল। আফিম ব্যবসারও অনুমােদন দেওয়া হল। বিদেশী শক্তিগুলি চীনের অভ্যন্তরে পণ্য বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করতেই থাকল। এ সত্ত্বেও উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে চীনের অভ্যন্তরে তাদের বাণিজ্য বেশী বাড়েনি। কোন বিদেশী শক্তিই চীন পুরােপুরি দখল করে নি। এর বড় কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিযােগিতা। কোন একটি দেশ যখন বেশী সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করত, তখন অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাে সম্মিলিতভাবে সেটা প্রতিরােধ করত। চীন সীমিত আকারে হলেও তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারল।
The Devastating Effects of Colonization on Hawai’i
উপনিবেশ স্থাপন ও তার প্রভাব
উপনিবেশ স্থাপনের প্রথম পর্যায়ে বাণিজ্যিক পুঁজির প্রভাব ছিল প্রধান। এই সময়কালে (উনবিংশ শতাব্দীর আগে) ইউরােপীয় দেশগুলিতে পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা বেশী ছিল না। উপনিবেশ স্থাপন করে প্রধানত: কয়েকটি উপায়ে লাভ করা হল: (১) প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পণ্যবাণিজ্যে পুরনাে বণিক ও নিয়ন্ত্রকদের সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করা যাতে এই বাণিজ্যের লাভ নিজেরা পায়। মশলা বাণিজ্যে বিভিন্ন ইউরােপীয় শক্তির আধিপত্য স্থাপন এর ভাল উদাহরণ। (২) উপনিবেশ দখল করে সেখানকার সঞ্চিত ধন সম্পদ জোর করে নিয়ে নেওয়া। দক্ষিণ আমেরিকার স্বর্ণ ও রূপা আহরণ এবং ভারতে লুটপাট এর উদাহরণ। (৩) যে সমস্ত পণ্য ইউরােপে তৈরী হয় না, অথচ চাহিদা আছে, সেগুলাে উপনিবেশ থেকে অতি স্বল্পমূল্যে সংগ্রহ করে বাজারজাত করা। আমেরিকার চিনি, তামাক ইত্যাদি ও এশিয়ার সুতীবস্ত্র, চা ইত্যাদির বাণিজ্য এর উদাহরণ। (৪) আফ্রিকায় দাস সংগ্রহ করে আমেরিকায় বিক্রি করা। জলদস্যুতা, লুটপাট, অপহরণ করে দাস চালান-এগুলাের মাধ্যমে লাভ একসময় কমে আসল। আক্রান্ত দেশ ও সমাজগুলির শতাব্দীর সঞ্চিত সম্পদ এক সময় শেষ হয়ে আসল।
তবে এই বিশাল সম্পদ আহরণ উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশগুলাের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। সাথে সাথে পৃথিবীর অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনও প্রভাবিত করেছিল। আন্তর্জাতিক পণ্য আদান প্রদান বাড়ায় সম্পদ আহরণকারী দেশগুলিতে পণ্য উৎপাদনের গতি বাড়ল এবং অর্থের আদান প্রদান বাড়ল এবং অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। ক্রমেই
এই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত সামন্তবাদী উৎপাদন প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করল। বর্ধিত উৎপাদনের জন্য কারখানায় উৎপাদন শুরু হল, যান্ত্রিক ও কৌশলগত আবিষ্কার হল ও প্রয়ােগ হতে লাগল। অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে থাকল। আগে উপনিবেশবাদী দেশগুলাে উপনিবেশে পণ্যদ্রব্য কিনত, অনেক সময় তার বিনিময়ে তাদের দেওয়ার মত পণ্য থাকত না। ক্রমেই তারা নিজেদের দেশে কারখানায় পণ্য উৎপাদন করে তা উপনিবেশে বিক্রি করতে লাগল। উপনিবেশে তারা তাদের দেশের উৎপাদনের জন্য দরকারী কাঁচামাল সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করল। এতে উপনিবেশগুলাের সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হল। তাছাড়া উপনিবেশগুলাের বিদ্যমান অবস্থায় শিল্পজাত পণ্যের চাহিদাও কম ছিল। এটাও বাড়ানর দরকার হল। এজন্য যে পরিবর্তনগুলাে করা হল তা হল: (১) বিদ্যমান ভূমি ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া, ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা চালু করা, বড় বড় খামারের ব্যবস্থা করা যেখানে কাঁচামাল উৎপাদন করা যাবে। এই প্রয়ােজনে কোন কোন স্থানে আদিঅধিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, কোন কোন জায়গায় তাদের হত্যা করে জমি দখল করা হল। (২) বাধ্যতামূলক শ্রমের মাধ্যমে খনি ও বাণিজ্যিক খামার এর শ্রমিক সৃষ্টি করা হল, (৩) ভূমির খাজনা ও অন্যান্য কর দেওয়ার জন্য মুদ্রা চালু করা হল, (৪) যেখানে উপনিবেশের কিছু শিল্প উৎপাদন গড়ে উঠেছিল, সেগুলাে ভেঙ্গে দেওয়া হল।৩২
সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, অবকাঠামাে, শিক্ষা ব্যবস্থা, এমনকি উপনিবেশের জনগণের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন করে ফেলে। দখলকারী দেশের প্রয়ােজনে এসমস্ত ঢেলে সাজান হয়। উপনিবেশের বা তার জনগণের প্রয়ােজনের কথা একদমই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। উপনিবেশ তখন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অংশ হয়ে যায়। উপনিবেশের কাঠামাে সম্পর্কে উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় জাতিয়তাবাদী নেতারা চারটি বিশেষত্ব চিহ্নিত করেন।৩ (১) উপনিবেশগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত করা হয়, কিন্তু তার অধিনস্ত করে। (২) উপনিবেশের অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগুলিকে বিনষ্ট করে উপনিবেশবাদী দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন অংশের পরিপূরক উপাদান গড়ে তােলা হয়। (৩) কর ব্যবস্থা, বিনিময় ব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপনিবেশের সামাজিক উদ্বৃত্ত উপনিবেশবাদী দেশে স্থানান্তর করা হয়। (৪) উপনিবেশের উপর শাসক দেশের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়। যে সমস্ত দেশ অন্য দেশের উপনিবেশ ছিল তাদের উপর উপনিবেশের যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি দ্রুত হবে এবং তারা শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হবে এরকম আশা অনেকেই করেছিলেন। কিন্তু উপনিবেশের ফলে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তনগুলাে ঘটান হয়েছে, তার ফলে তাদের পক্ষে শিল্পোন্নয়ন সম্ভব হয়েছে,“শিল্প-বিপ্লব” নয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্তির কারণে যে সমস্ত বিকৃতি আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় বহু যুগ ধরে ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে নতুন আর্থ-সামাজিক অবকাঠামাে গড়ে না তুললে পরিপূর্ণ উন্নয়ন সম্ভব নয়, এটা কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন। উপনিবেশবাদের বিশ্লেষণ তাই শুধু ইতিহাস জানার জন্যই প্রয়ােজন তা নয়, ভবিষ্যতের উন্নয়নও এখান থেকে শিক্ষা না নিলে দুরূহ হবে।
তথ্য সূত্র:
- Harman C. A People’s History of the World. London, 1999 p 163 3. Roberts JM. The Pelican History of the World. Harmondsworth, 1976 p 611 o. Quoted in:Harman C. p 169 8. Prescott WH. The Conquest of Peru. New York, 1961 p 253 Q. Hemmings J.The Conquest of Peru. London, 1970 p 407 y Davis R. The Rise of Atlantic Economies. New York, 1973 p 45 4. Roberts JM. p 612 b. Blackburn R. The Making of New World Slavery. London, 1973 p 3 d. Manning P. Slavery and African Life. Cambridge, 1990 p 104 30. Harman C. p 252 ss. Harman C. p 161 32. Quoted in: Smith AK. Creating a World Economy, Merchant Capital, Colonialism and World
Trade 1450-1825. Boulder, 1991 p 226 so. Davis R. The Industrial Revolution and the British Overseas Trade. Leicester,1979 p 10 38. Hobsbawm E. Industry and Empire:An Economic History of Britain since 1750. London, 1968 p
32 se. Smith AK. p 78 sy. Kamen H. Spain, 1469-1714. London, 1983 p 167 39. Roberts JM. p 606 Sb. Roberts JM, p 607 ss. Harman C. p 396 20. Anstey V. The Economic development of India. London, 1929 33. Harman C. p 356-7 32. Chomsky N.World Orders Old and New. New York, 1994 p 115 20. Quoted in Chomsky N. p 115 18. Chomsky N. p 116 16. Harman C. p 356 py. Chandra B. Essays on Colonialism. Hyderabad, 1999 p 82 39. Chandra B. p 295 26. Roberts JM. p 777 Ra. Magdoff H. Imperialism from the Colonial Age to the Present. Delhi, 2009 p 49 vo. Harman C. p 361 os. Magdoff H. p 3, 4 us. Magdoff H. p 18,19 vo. Chandra B. p 10-12 08. Chandra B. p 40 06. Chandra B. p viii
সাম্প্রতিক মন্তব্য