মুক্ত কর হে বন্ধ- নবম অধ্যায় (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ার বিপ্লব)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ার বিপ্লব
উনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লব এর ফলে ইউরােপের দেশগুলিতে শিল্প কারখানায় বড় আকারে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন হতে থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের প্রকৃতিই হল আরও বেশী উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রীর লভ্যাংশ দিয়ে আরও উৎপাদনের জন্য কল-কারখানা তৈরী করা, যাতে লাভ আরও বাড়ান যায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় এশিয়া, আফ্রিকা ও অন্যান্য মহাদেশের দেশগুলিকে ব্যবহার করা হত কমদামে কাঁচামাল কেনার উৎস হিসাবে আর বেশী দামে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করার বাজার হিসাবে। এই দেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এভাবে তাদের ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না, তাই তাদের শাসনভার পুঁজিবাদী দেশগুলাে নিয়ে নিয়েছিল তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী দেশগুলাে তাদের উপনিবেশ বাড়ানর প্রতিযােগিতা শুরু করল। পৃথিবীর সব মহাদেশে তারা জোর করে এক একটা দেশ দখল করতে থাকল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইউরােপের বাইরে মাত্র কয়েকটি হাতে গােনা দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিল। পৃথিবীতে যখন আর নতুন উপনিবেশ করার আর সুযােগ রইল না, তখন পুঁজিবাদী দেশগুলাে একে অন্যের উপনিবেশের উপর নজর দিল।
এই সময় ইংল্যান্ড ছিল পৃথিবীর সবচাইতে শিল্পোন্নত দেশ, আর তার ছিল সবচাইতে বড় সাম্রাজ্য। জার্মানী ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র শিল্পে প্রভূত অগ্রগতি করে ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় নেমেছিল। তাদের উৎপাদিত পণ্য ইংল্যান্ডের চাইতে দামেও কম ছিল। ফলে ক্রমেই তারা বাজার দখল করে নিচ্ছিল। জার্মানী শিল্প বিজ্ঞান ও শিক্ষায় অনেক এগিয়ে গিয়েছিল, একটা শক্তিশালী সামরিক বাহিনীও গড়ে তুলেছিল। জাহাজ তৈরীতেও তারা উন্নতি করেছিল। জার্মানীর বাণিজ্যিক জাহাজগুলাে জার্মানীর নিজস্ব পণ্য বহন তাে করতই অন্যান্য দেশের পণ্য নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় বন্দরগুলিতে যাওয়া আসা শুরু করেছিল। জার্মানী যুদ্ধ জাহাজও তৈরী করতে শুরু করল। জার্মানীর উপনিবেশও তেমন ছিল না। আর অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের উপনিবেশ দখল না করলে তার সাম্রাজ্য বাড়ানর সুযােগও ছিল না। আর সাম্রাজ্য না বাড়লে কাঁচামালের উৎস ও পণ্যের বাজারও বাড়ান যেত না-যেটা তার শিল্পের অগ্রযাত্রার জন্য ছিল প্রয়ােজন।
উপনিবেশের প্রতিযােগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছিল। দেশগুলি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। একদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া- আর একদিকে ছিল জার্মানী, অস্থীয়া ও ইতালী ( ইতালী পরবর্তীতে অন্যপক্ষে যােগ দেয়)। যুদ্ধ প্রস্তুতিতে লাভবান হচ্ছিল অস্ত্র উৎপাদনে নিয়ােজিত শিল্পগুলি। সব দেশেই এই সব শিল্পের মালিকানায় অনেক রাজনীতিবিদের অংশ ছিল। রাজনীতিবিদরাও তাই যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা করছিল।
এই সময় বলকান উপদ্বীপে সংঘাতময় পরিস্থিতি ছিল। এখানে ছিল বিভিন্ন জাতীয়তা-আর তাদের ছিল বিরােধ। বসনিয়া ছিল অষ্ট্ৰীয় সাম্রাজ্যের অংশ, সার্বিয়া ছিল পৃথক রাজ্য-তাদের মিত্র ছিল রাশিয়া। ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অয়ার যুবরাজ বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভােতে আততায়ীর হাতে নিহত হন। অন্থীয়া এটার জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করল। ২৮ শে জুলাই অষ্টয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল। রাশিয়া শুরু করল যুদ্ধ প্রস্তুতি। ১ লা আগষ্ট জার্মানী যুদ্ধ ঘােষণা করল রাশিয়া আর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধের ফল হল বিপ্লব, বিশেষভাবে রাশিয়ার বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়া একটি পশ্চাদপদ দেশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। এর প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে সংগঠিত ও শক্তিশালী বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল এর মাধ্যমে, যা চল্লিশ বছরের মধ্যেই মানব জাতির এক তৃতীয়াংশকে সংগঠিত করে তার প্রভাব বলয়ে নিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে ইউরােপের প্রায় সব রাষ্ট্রের কাঠামােই ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেম কাজ করলেও যতই যুদ্ধ সব রাষ্ট্রের মানুষকে হত্যা, ধ্বংস ও দুঃখকষ্টের সম্মুখীন করল ততই মানুষ যুদ্ধ বিমুখ হতে লাগল। দেশগুলিতে যারা যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন, যুদ্ধের শুরুতে তাদের পক্ষে কোন সমর্থন ছিল না। ১৯১৬ সাল নাগাদ তাদের পক্ষে অনেকেই এসে গেল। যুদ্ধের প্রয়ােজনে সব যুদ্ধরত দেশেই বড় বড় সমরাস্ত্র তৈরীর কারখানা তৈরী হয়েছিল, এখানে কর্মরত দক্ষ শ্রমিকেরা, যারা যুদ্ধ চালানর জন্য অপরিহার্য ছিল, তারা সংগঠিত হয়ে যুদ্ধবিরােধী অবস্থান নিয়েছিল। সমাজতন্ত্রী দলগুলাে শ্রমিক শ্রেণীর সমর্থন নিয়ে পুঁজিবাদী যুদ্ধ বন্ধ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে এরকম সম্ভাবনা অনেক দেশেই আছে বলে মনে হচ্ছিল।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও পরাজয়ের কাছাকাছি রাশিয়া ছিল সমাজ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত। প্রথম রাশিয়াতেই বিপ্লব শুরু হয়। এই লুণ্ঠনের যুদ্ধের কারণে সামনের বছর গুলােতে ইউরােপে সর্বহারাদের গণজাগরণ ঘটবে” জুরিখে শ্রমিকদের এক সভায় লেনিন ১৯১৭ সালের জানুয়ারীতে একথা বলেন। ছয় সপ্তাহ পরে প্রথম অভ্যুত্থান ঘটে রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাদে। রাশিয়ার জারের ক্ষমতা এর দু সপ্তাহ আগেও একচ্ছত্র বলে মনে হচ্ছিল। তিনি ১৯১৭ সালের ২রা মার্চ সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হলেন। নভেম্বরের মধ্যে লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। ১৯১৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী বিপ্লব ঘটবে তা কেউ মনে করেনি। ঐদিন “আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মহিলাদের দিবস পালিত হচ্ছিল। পেট্রোগ্রাদের গােপন সমাজতান্ত্রিক গােষ্ঠীগুলি এই উপলক্ষে প্রচারপত্র ছেপেছিল ও সভার আয়ােজন করেছিল, কিন্তু ধর্মঘট কেউ ডাকে নি, কারণ পরিস্থিতি জঙ্গী আন্দোলনের জন্য অনুকূল তা কেউ মনে করেনি। যুদ্ধজনিত খাদ্য ঘাটতির জন্য মহিলারা ছিল বিক্ষুব্ধ, তারা ধর্মঘট করল ও অন্যান্য শ্রমিকদের যােগ দিতে আহ্বান জানাল। পরদিন এই ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ল। পেট্রোগ্রাদের চার লক্ষ শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকই যােগ দিল। যুদ্ধ বন্ধ ও খাদ্যের দাবীতে আন্দোলন শুরু হল। জারের সরকার এটা দমন করার জন্য সশস্ত্র পুলিশ পাঠাল আর যুদ্ধে যাওয়ার অপেক্ষায় যে সৈন্যদল ছিল তাদের পাঠাল। কিন্তু ধর্মঘটের চতুর্থ দিনে সৈন্যরাও বিদ্রোহ করল। শ্রমিক ও বিদ্রোহী সৈন্যরা সম্মিলিতভাবে পুলিশ ও সরকারী কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা শুরু করল। বিদ্রোহ দমন করার জন্য অন্যান্য শহর থেকে সৈন্য আনার উদ্যোগ নিলে রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে তাতে বাধা দিল। যে সব সৈন্য আসতে পারল তারাও বিদ্রোহে যােগ দিল। রাশিয়ার অন্যান্য শহরেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। জারের সেনাধ্যক্ষরা তাকে বলল সিংহাসন না ছাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জার ২রা মার্চ সিংহাসন ছাড়লেন। শাসনকাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো সমান্তরাল সংগঠন দাঁড়িয়ে গেল। একটা হল জারের আমলের রাষ্ট্রীয় দুমার (duma) একটা অংশ। দুমা ছিল নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা-যদিও নির্বাচন সীমিত ছিল বিত্তশালী শ্রেণীর মধ্যে, তারাই দুমাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। অপর সংগঠনটি ছিল শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগােষ্ঠীগুলি যা ছিল সােভিয়েত (বা কাউন্সিল) নামে পরিচিত। সােভিয়েতগুলির সম্মতি নিয়ে দুমা সরকার গঠন করল। দুমার অনেক সদস্যই জারের সরকারের সহযােগী ছিল এবং শিল্প কারখানার মালিক হিসাবে সরকারের কাছে যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রি করে লাভ করছিল। কিন্তু জার এর পারিষদদের দুর্নীতিতে তারা ছিল বিক্ষুব্ধ। তারা চাচ্ছিল সংস্কার, বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা উৎখাতের কোন চিন্তা তাদের ছিল না। নতুন সরকার এই অংশের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরী হল। অন্যদিকে “সােভিয়েত” গড়ে তােলা হয়েছিল প্রথমে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক সংগঠনগুলাের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য। বিদ্রোহী সৈন্যদের প্রতিনিধিরা যখন এতে যােগ দিল, তখন তা হয়ে দাঁড়াল সবধরনের বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তারা সৈন্য বাহিনীর খাদ্য সরবরাহের কাজ করতে লাগল। এছাড়া শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা, জারের আমলের পুলিশ ও সরকারী কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার, জনসাধারণকে ঘটনা প্রবাহ সম্মন্ধে অবহিত রাখার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করা, এগুলােও তারা করতে লাগল। দেশের অন্যান্য স্থানেও এই আদলে সােভিয়েত গড়ে উঠল এবং তারা পেট্রোগ্রাদ সােভিয়েতের নির্দেশাবলী মেনে কাজ করতে লাগল। কার্যত এরাই সরকারের সব কর্মকান্ড চালাচ্ছিল কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের দায়িত্ব না নিয়ে তা দুমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। শ্রমিকদের সােভিয়েতগুলাে জারের আমলে নিষিদ্ধ ঘােষিত সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের দ্বারা কমবেশী প্রভাবিত ছিল। এই দলগুলাের নেতাকর্মীরা অনেকেই ছিলেন কারাবন্দী, অনেকে আত্মগােপন করে ছিলেন, অনেকে ছিলেন নির্বাসনে। কিন্তু তাদের নেতাদের আদর্শ ও ভাবমূর্তি শ্রমিকদের অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই দলগুলাের কোনটাই এই সময় দুমার ক্ষমতা নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানায় নাই বা শ্রমিক সংগঠনগুলােকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করে নি। আন্দোলনের কৌশল নিয়ে এই দলগুলাের মধ্যে মত পার্থক্য ছিল তবে একটা বিষয়ে মােটামুটি সবাই একমত ছিল-এই বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। রাজতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র স্থাপন করা হবে-যদিও এই গণতন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা থাকবে ধনিক শ্রেণীর। পুঁজিবাদ বিকশিত হবে। পেট্রোগ্রাদে বলশেভিক দলের প্রথম যে দুজন নেতা এসে পৌছুলেন, ষ্ট্যালিন ও মলােটভ, তারা দুমার সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারকে মেনে নিলেন। একজন নেতা দ্বিমত পােষণ করেছিলেন-তিনি ছিলেন লিও ট্রটস্কী। তাঁর মতে এই বিপ্লব সর্বহারাদের বিপ্লব হতে পারে, কিন্তু তিনি তখন ছিলেন বলশেভিক দলের বাইরে এবং আমেরিকায় নির্বাসনে। দুমার সরকারকে সােভিয়েত সমূহের শ্রমিক প্রতিনিধিরা তাদের স্বার্থের অনুকূল মনে করে নি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে তারা যেতে পারেনি। বিপ্লবী সৈন্যরা অবশ্য আরও সহজে দুমার সরকার মেনে নিয়েছিল। পশ্চাদপদ সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে জারতন্ত্র জার্মানীর সঙ্গে যুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। জার্মানী ছিল তক্কালীন বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলাের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। ফল হয়েছিল যুদ্ধে ব্যাপক হতাহত, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে শহরে খাদ্য ঘাটতি ও শহরের শ্রমজীবী মানুষের দুর্গতি। অথচ শাসক শ্রেণী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাচ্ছিল, কারণ পুঁজিপতিরা যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদন করে প্রচুর মুনাফা করছিল, আর যুদ্ধের মাধ্যমে নতুন সাম্রাজ্য জয় করে উৎপাদিত পণ্যের বাজার বাড়াতে চাচ্ছিল। শহরের দরিদ্র মানুষের দাবী ছিল খাদ্য, শ্রমিকদের দাবী ছিল বেতনবৃদ্ধি। আর রাশিয়ার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী, তাদের দাবী ছিল জমি। এরা সবাই চাইছিল যুদ্ধ শেষ করতে।
ফেব্রুয়ারী মাসে বলশেভিকরা সংখ্যায় কম ছিল, তাদের চাইতে সােশ্যাল রিভলিউশনারী দল (Social Revolutionary) এর সমর্থন ছিল বেশী। দুমার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রিভলিউশনারী দলের বড় অংশ এতে সমর্থন দেয়। বলশেভিকরা যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে দাঁড়ায়। বলশেভিক দলের সঙ্গে অন্যান্য দলের একটা পার্থক্য ছিল, সেটা হল বিপ্লবের প্রায় ১৫ বছর আগে থেকে তারা শ্রমিকদের মধ্যে একটা অংশের সমর্থন তৈরী করেছিল। রাশিয়া শিল্পে পশ্চাদপদ হলেও পেট্রোগ্রাদে অনেকগুলি কারখানা ছিল-যার মােট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল আড়াই লক্ষ। এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন থেকে রাশিয়া ফিরে আসেন এপ্রিল মাসে। ১৯০৬ সাল থেকে লেনিনের মত ছিল রাশিয়ার বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। কিন্তু রাশিয়া সহ ইউরােপের অনেক দেশে বিস্ফোরনুখ পরিস্থিতিতে তার মত পরিবর্তন হল। লেনিন এসে যে অবস্থান নিলেন তা হল এই পুঁজিবাদ রাশিয়ায় সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। শ্রমিকশ্রেণী জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবচাইতে গণতান্ত্রিক পন্থা ব্যবহার করেছে, তারা ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণী ও তাদের চাইতেও সংখ্যায় বেশী কৃষকশ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে। কাজেই ক্ষমতা হাতে নেওয়া দরকার। লেনিনের বক্তব্যের বিরােধিতা করল বেশীর ভাগ বলশেভিক । দু সপ্তাহের মধ্যে লেনিন তার পক্ষে নিয়ে আসলেন দলের অধিকাংশ মানুষকে, তবে শ্রমিকদের বড় অংশকে পক্ষে নিয়ে আসতে সময় লাগল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, শ্রমিকদের প্রতিটি আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ, ও বড় ভূস্বামীদের কাছ থেকে কৃষি জমি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিতরণের দাবীর সাথে বলশেভিকরা দাঁড়াতে তাদের সমর্থন বাড়তে থাকল। ১৯১৭ সালের মার্চে তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার, কয়েকমাসের মধ্যেই তা বেড়ে আড়াই লক্ষের উপরে চলে গেল। লেনিন ও বলশেভিকদের প্রধান হাতিয়ার ছিল জনগণ কি চায় তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা ও তার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। যেমন বলশেভিকরা যখন বুঝতে পারল কৃষকেরা চায় জমি তখন তারা এটার পক্ষে দাঁড়াল, যদিও এটা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
ইউরােপের রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে রাশিয়া ছিল অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নতির দিক দিয়ে পশ্চাদপদ দেশ। মার্কস ও তাঁর অনুসারীরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি স্থাপনের যে সব পূর্বশর্ত প্রয়ােজন বলে বর্ণনা করেছিলেন তা তৎকালীন রাশিয়াতে ছিল না। রাশিয়ান বিপ্লবের নেতারা ধারণা করেছিলেন রাশিয়ার বিপ্লব ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলােতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে স্ফুলিঙ্গের কাজ করবে।
দুমার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তবতা বুঝতে পারে নি। পুঁজিবাদীরা কারখানার শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য আইন খাটানর চেষ্টা করল। সরকার জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ১৯১৭ সালের জুন মাসে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জার্মানীর বিরুদ্ধে নতুন আক্রমণ শুরু করার চেষ্টা করল তখন সৈন্যরা সৈন্যবাহিনী ছেড়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে বড় ভূস্বামীদের জমি কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া শুরু করল। বলশেভিকদের প্রভাব ও সমর্থন বাড়তে লাগল। বড় দুটি শহর পেট্রোগ্রাদ ও মস্কোতে তারা হয়ে গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সৈন্যবাহিনীতেও তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে লাগল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে গেল দুর্বল। আগষ্ট মাসে একজন জারতন্ত্রপন্থী জেনারেল (জেনারেল কর্ণিলভ) সরকার উৎখাত করার জন্য বাহিনী নিয়ে পেট্রোগ্রাদের দিকে অভিযান চালান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিরােধ করার জন্য বিপ্লবীদের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন, এরপরও ক্ষমতা নেওয়া অবধারিত ছিল না। ২৫ শে অক্টোবর নিখিল রাশিয়া সােভিয়েতের কংগ্রেস এর সভায় ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষে সংখ্যাধিক্য ছিল। কিন্তু জিনােভিয়েভ ও কামেনেভের নেতৃত্বে একটি অংশ এর বিরােধিতা করে। লেনিন ও ট্রটস্কী (যিনি আগেই বলশেভিক দলে যােগ দিয়েছিলেন ) ক্ষমতা নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। দেরী করলে জনগণ বিভ্রান্ত হবে এবং এর সুযােগে ধনিকশ্রেণী শ্রমিকদের আন্দোলন ও সংগঠন ধ্বংস করবে এটা তারা বল্লেন।
২৫শে অক্টোবর (পুরনাে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) সােভিয়েত সমর্থকরা দুমার অন্তর্বর্তীকালীন (Provincial) সরকারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে ক্ষমতা দখল করল। ফেব্রুয়ারী মাসের বিপ্লবের চাইতে অক্টোবর বিপ্লবে সংঘর্ষ ও রক্তপাত কম হয়েছিল। এই কারণে ডানপন্থী ঐতিহাসিকেরা কেউ কেউ বলেন যে এটা বিপ্লব ছিল না, ছিল অল্প সংখ্যক মানুষের দ্বারা অভুত্থান, জনসাধারণের সমর্থন এতে ছিল না। কিন্তু সংগঠিত প্রতিনিধিসভা সােভিয়েতের মাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থন থাকা, শ্রমিক, সৈন্যবাহিনী ও জনসমর্থন থাকার কারণেই অক্টোবর বিপ্লবে সংঘর্ষ ও রক্তপাত কম হয়েছিল।
বিপ্লবী সরকার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হল। জনগণ যুদ্ধ চাচ্ছিল না। শহরের মানুষ চাচ্ছিল খাদ্য। গ্রামের মানুষ চাচ্ছিল জমি, দেশের সংখ্যাধিক জনগণ যারা ছিল কৃষক-তারা সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছিল এই কারণে যে তারা জমি পাবে । শহরের মাথাপিছু খাদ্য ছিল তখন প্রায় ১৫০০ ক্যালরী। শহরের কারখানাগুলােতে উৎপাদন বাড়িয়ে গ্রামের কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারলে তবেই কৃষকদের শহরে খাদ্য সরবরাহ করতে রাজী করান যেত। এটা ছিল বেশ কঠিন। শিল্পোন্নত দেশগুলােতে বিপ্লব হয়ে সেখানকার সাহায্য না পেলে এটা সম্ভব ছিল না। ১৯১৮ সালে লেনিন বলেছিলেন জার্মানীতে বিপ্লব না হলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।’ নবগঠিত সােভিয়েত সরকার রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রায় ছয়মাস স্থায়ী আলােচনার পর ৩রা মার্চ ১৯১৮ সােভিয়েত রাশিয়া তাদের দিক থেকে অবমাননাকর ও ক্ষতিকর শান্তি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হল। বলশেভিক দলের একটা অংশ এবং তাদের সহযােগী সােশ্যাল রিভলিউশনারী দল এই রকম ক্ষতিকর চুক্তির বিপক্ষে ছিল। লেনিন যুক্তি দিলেন রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি নাই। অন্যান্য দেশে বিপ্লবী আন্দোলন সফল হল না। অস্থীয়া, হাঙ্গেরী ও জার্মানীতে ১৯১৮ সালের জানুয়ারীতে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন হল, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত দমন করা হল। এদিকে জার্মান বাহিনীও রাশিয়ার অভ্যন্তরে এগিয়ে যেতে লাগল। লেনিন বলশেভিক দলের অধিকাংশকে শান্তিচুক্তি মেনে নিতে রাজী করাতে পারলেন। এই চুক্তির ফলে পূর্বর্তন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের এক চতুর্থাংশ জনসংখ্যা হারাতে হল, এক চতুর্থাংশ শিল্প কারখানাও হারাতে হল আর কয়লা খনির নয় দশমাংশ হারাতে হল। এছাড়া এই অঞ্চল হতে রাশিয়ার অধিকাংশ খাদ্যশস্য আসত। রাশিয়ার শিল্প উৎপাদন যুদ্ধ বিপর্যস্ত তাে ছিলই (যুদ্ধের আগের তুলনায় ১৯২১ সালে রাশিয়ার অর্থনীতির আকার ছিল এক দশমাংশ), এর পর জ্বালানীর অভাবে তা আরও সংকুচিত হল। শহরগুলিতে খাদ্য সংকট আরও বাড়ল। পেট্রোগ্রাদে মাথাপিছু রুটির বরাদ্দ কমিয়ে ২৭শে জানুয়ারীতে করা হল ১৫০ গ্রাম, ২৮শে ফেব্রুয়ারীতে আরও কমিয়ে করা হল ৫০ গ্রাম। পেট্রোগ্রাদের শ্রমিক শ্রেণীর উপর এর প্রভাব ছিল ধ্বংসাত্মক। ১৯১৭ সালের জানুয়ারী মাসের পর তিন মাসে মানুষ শতকরা ৬০ ভাগ কমে গেল। ১৯১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে খাদ্যের অভাবে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ পেট্রোগ্রাদ ছেড়ে চলে গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই পেট্রোগ্রাদের সাহসী শ্রমিক শ্রেণী যারা বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল তাদের একটা বড় অংশ হারিয়ে গেল। শ্রমিকশ্রেণীর যে অংশ শিল্প উৎপাদনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল তারা আর থাকল না।
তাদের গড়া সােভিয়েতগুলাে থাকল কিন্তু শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সংযােগ হারিয়ে গেল। বিপ্লবের উদ্দীপনা তার পরেও থাকল, আরও অনেক শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক বলশেভিকদের দলে যােগ দিল। লিও ট্রটস্কী প্রায় দশ লক্ষ সৈন্যের লাল ফৌজ (Red Army) গড়ে তুললেন। কিন্তু সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণী আগের মত সােভিয়েত সমূহ, বলশেভিক দল ও লালফৌজের অংশ থাকল না।”
দীর্ঘমেয়াদে বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল ও রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্থাপন নির্ভর করছিল “বিশ্ব বিপ্লব” বা অন্ততঃপক্ষে ইউরােপীয় দেশসমূহে বিপ্লব হওয়ার উপর। যতদিন তা না হয় ততদিন বলশেভিকদের ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে, লক্ষ হচ্ছে সমাজতন্ত্র স্থাপন, এই ঘােষণা দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলােকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল আর শ্রমিকদের কল-কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিতে বলা হয়েছিল। এছাড়া বিপ্লবী সরকার সমাজতন্ত্র স্থাপন করার জন্য বড় কোন পদক্ষেপ নেয়। নাই। ১১ সােভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল কয়েকটা ডানপন্থী গােষ্ঠী, এর মধ্যে ছিল জারপন্থীরা, বলশেভিকদের বামপন্থী বিরােধীরা,ও বিদেশী সমর্থনে বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর (চেক, পােলিশ) বাহিনী। ১৯১৮ সালের জুন ও জুলাই মাসে ফ্রান্স ও বৃটেন সােভিয়েত বিরােধী বাহিনী সংগঠিত করল। ত্রিশ হাজার চেকোশ্লোভাক সৈন্য ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেল পথের অনেকটা এলাকা দখল করে রাশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমের সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। এদের ছত্রছায়ায় দক্ষিণপন্থী সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট ও মেনশেভিকরা Saratov এ সরকার গঠন করল। বলশেভিক সন্দেহ হলেই এরা তাদের হত্যা করা শুরু করল।১২ জাপানী সৈন্যরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্লাদিভষ্টক দখল করল। বৃটিশরা উত্তরে মুরমানস্ক ও দক্ষিণে বাকু দখল করল। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই আভ্যন্তরীন ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে সবচাইতে কঠিন সময়ে সােভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ একটা ক্ষুদ্র এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল, যা ছিল ভূ-বেষ্টিত-সমুদ্রে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না।
গৃহযুদ্ধ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ দুটো মিলিয়ে বিপ্লবী সরকারের চরিত্রে পরিবর্তন আনল। ভিক্টর সার্জ নামে এক বলশেভিকের ভাষায় প্রজাতন্ত্রের সমস্ত ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীন গণতন্ত্র ছিল। তখনও দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা দলে কয়েকজন নেতার একনায়কত্ব হয় নাই। ধনী কৃষকদের বিদ্রোহ, বলশেভিকদের সাথে বামপন্থী সােশ্যাল রিভলিউশনারীদের মৈত্রীর অবসান এবং একই সময়ে মিত্র শক্তির (বৃটেন, ফ্রান্স), ইত্যাদির আক্রমণ প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করল। সর্বহারাদের একনায়কত্ব গণতান্ত্রিক ও যে পদ্ধতিগুলাে ছিল তা বাদ দিতে হল। দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতার ফলে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল। ষড়যন্ত্রের ফলে আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হল। অন্যান্য দলের সঙ্গে মৈত্রী ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে কমিউনিষ্ট পার্টির হাতে একছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা আসল। এই সময় প্রথম বারের মত বিপ্লবী সরকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাস ব্যবহার করতে বাধ্য হল। প্রতিবিপ্লবীরা বিপ্লবের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সন্ত্রাস এর আগে থেকেই ব্যবহার করা শুরু করেছিল (“শ্বেত সন্ত্রাস”)। বিপ্লবের সমর্থকরা মনে করল তাদের সন্ত্রাস প্রয়ােগ করার বিকল্প নাই। যাদের প্রতিবিপ্লবী সন্দেহ করা হত তাদের মেরে ফেলা হত। ধনিক শ্রেণীর সদস্যদের জিম্মি করা ও অন্যান্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিরােধীদের দমন করা বৈপ্লবিক কর্মধারার অংশ হয়ে পড়ল। এটা ছিল সত্যিকারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা ব্যবস্থা। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২১ সালে এটাও শেষ হয়।
জার্মান আক্রমণ ও কঠোর শর্তে সন্ধি চাপিয়ে দেওয়া, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক ধ্বস, গৃহযুদ্ধ ও প্রতিবিপ্লব, অনেকগুলাে বিদেশী শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের পরও সােভিয়েত রাশিয়া টিকে গেল। অনেকেই মনে করেছিলেন সােভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে পড়বে। টিকে গেল প্রধানতঃ তিনটি কারণে প্রথমতঃ তার ছিল প্রায় ছয় লক্ষ সদস্যবিশিষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ ও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত কমিউনিষ্ট পার্টি, বিপ্লবের পর এর শক্তি আরও বেড়েছিল ও সংহত হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ যারা কমিউনিষ্ট সমর্থক নয় কিন্তু দেশপ্রেমিক এমন রাশিয়ানরাও বুঝতে পেরেছিল একমাত্র কমিউনিষ্ট পার্টিই রাশিয়ার ঐক্য ধরে রাখতে পারে ও অরাজকতা রােধ করতে পারে। তৃতীয়তঃ দরিদ্র কৃষকরাও বিপ্লবের মাধ্যমে জমি পেয়েছিল, দেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। ও যারা সােভিয়েত রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রে বড় অংশ ছিল, তারাও বিপ্লবের পক্ষে ছিল।
গৃহযুদ্ধের ফলে ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষতি হয়েছিল। যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল, বিশেষত রেলপথ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রেলপথে খাদ্য ও জ্বালানী বহন অনেক কমে গিয়েছিল। শহরের অধিবাসীদের প্রথমে জ্বালানী তৈল সরবরাহ তারপর কয়লা সরবরাহ কমে গেল। শহর ছেড়ে মানুষ চলে যেতে লাগল। উত্তরাঞ্চলের শহরগুলিতে (যে গুলাে ছিল খাদ্য ও জ্বালানী থেকে দূরে) জনসংখ্যা গড়ে এক চতুর্থাংশ কমে গেল। উত্তরাঞ্চলের শহরগুলাের অধিবাসীরা দক্ষিণে (যেখানে খাদ্য উৎপাদন হত) চলে যেতে লাগল। বিশেষ করে শহরের শ্রমিকরা খাদ্যাভাবের কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে লাগল। শ্রমিকের অভাবে শিল্প উৎপাদন কমে গেল। এ ছাড়া শহরের শ্রমিক শ্রেণী ছিল বলশেভিক দলের মূল সমর্থক। তাদের সংখ্যা কমে গেল ও যারা থাকল তাদের মধ্যেও বলশেভিকদের সমর্থন কমে গেল। মানুষ তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবান জিনিষ বিক্রি করে খাবার কিনা শুরু করল। কালাে বাজারে জিনিষপত্রের লেন দেন হতে থাকল। এর উপর ১৯২০-২১ সালে অনাবৃষ্টির কারণে খাদ্যাভাব হয়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ভলগা অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেল। ১৯২১ সালে মস্কো শহরে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করা শুরু করল। ১৭১৯১ সালের তুলনায় (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে) ১৯২০ সালে কৃষি উৎপাদন ছিল শতকরা ২০ ভাগ আর শিল্প উৎপাদন ছিল শতকরা ১৩ ভাগ। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন ১৯২১ সালে New Economic Policy (NEP) ঘােষণা করলেন। এটা নিয়ে সােভিয়েত নেতৃত্বে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল, অনেকেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেছিলেন। লেনিন বেশীরভাগ নেতাকে বােঝাতে সক্ষম হলেন ও নিখিল রাশিয়া কমিউনিষ্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে এটা গৃহীত হয়। শিল্প উৎপাদনে ব্যক্তি মালিকানায় ছােট ছােট শিল্প কারখানা স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হল। বৃহৎ শিল্প, ব্যাংক, ও বৈদেশিক বাণিজ্য থাকল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। কৃষকদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক শস্য নিয়ে নেওয়া বন্ধ করা হল। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য কৃষকরা রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকল- বাকী শস্য তাদের বাজারে বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হল। NEP-র একটা প্রধান লক্ষ ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা। এটা করা হল যেহেতু কৃষকরা তখনও যৌথ খামার গ্রহণ করতে রাজী ছিল না। NEP-র ফলে সরকারী পদগুলােতে দক্ষ পেশাজীবীদের যেমন-প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষক ইত্যাদি, নেওয়ার ব্যবস্থা হল। এতে সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে একটা আলাদা গােষ্ঠীর সৃষ্টি হল। আরও ছিল ছােট শিল্পের মালিকেরা, সমৃদ্ধ কৃষক, যারা অন্য মানুষদের তাদের জমিতে কাজ করাত, এরা সবাই ছিল সমাজতন্ত্রের বিরােধী। এরা NEP-র এর লােক (NEP-men) নামে পরিচিত ছিল।
NEP-র ফলে কৃষি উৎপাদন পরের বছরই (১৯২২-২৩) শতকরা ৪০ ভাগ বাড়ল। দেশের বড় শিল্পগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ছিল এবং সে গুলাের উৎপাদন বাড়ানর আলাদা উদ্যোগ নেওয়া হয় নাই, তাই তুলনামূলকভাবে পরবর্তী বৎসরগুলিতে কৃষি উৎপাদন বেশী বাড়ল। প্রথম মহাযুদ্ধ ও পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধের ফলে যে ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষতি রাশিয়ার হয়েছিল তা পূরণ করতে NEP সক্ষম হল। ১৯২৮ সাল নাগাদ প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ১৯১৩ সালে রাশিয়ার কৃষি ও শিল্প উৎপাদন যে পর্যায়ে ছিল সেই পর্যায়ে ফিরে গেল।
সমাজতন্ত্র গঠনের ব্যাপারে দুজন প্রভাবশালী নেতা লিও ট্রটস্কী ও যােসেফ ষ্ট্যালিন এর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। ট্রটস্কী ও তাঁর সমর্থকরা মনে করতেন রাষ্ট্রকে সব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উদ্বৃত্ত সম্পদ দ্রুত শিল্পায়নের কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া সােভিয়েত রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারবে না। ষ্ট্যালিন ও তার সমর্থক রক্ষণশীলরা NEP- র সমর্থক ছিলেন ও মনে করতেন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প থাকবে, কিন্তু সব শিল্প এবং কৃষি উৎপাদন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সময় সাপেক্ষ। লেনিনের মৃত্যুর সময় সােভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি অনুগত ছিল এই কারণে যে, যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন ও সিদ্ধান্ত দিতেন তাদের এই আনুগত্য ছিল। কিন্তু বিপ্লবের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছিল। দল নির্ভর করতে লাগল রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাদের উপর ও যারা অর্থনীতি পরিচালনায় সহযােগিতা দিতেন NEP-men দের উপর। শ্রমিকদের স্বার্থ কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছিল। ট্রটস্কীর নেতৃত্বে দলের একটি অংশ এর বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেন, এদের বক্তব্য ছিল শিল্প কারখানা তৈরী করার দিকে জোর দিতে হবে, তাতে শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যা বাড়বে। সাথে সাথে শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন গণতন্ত্র ভিত্তিক হতে হবে। দলে আমলাদের প্রভাব কমাতে হবে। যতদিন বিপ্লব অন্যান্য দেশে সফল না হচ্ছে ততদিন শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র এভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে। দলের নেতৃত্বে প্রভাবশালী অংশে ছিল ষ্ট্যালিন, বুখারিন, কামেনেভ, জিনােজিয়েভ। এরা ট্রটস্কীর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করলেন। ট্রটস্কীকে “লালফৌজ” এর প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। এই পর্যায়ে স্ট্যালিন ও তার সহযােগীরা এক দেশে সমাজতন্ত্র (socialism in one country) এই মত প্রকাশ করেন। এর আগে বলশেভিক নেতাদের মত ছিল শ্রমিকরা একটি দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে কিন্তু পূর্ণ সমাজতন্ত্র অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিপ্লব না হলে সম্ভব হবে না। ষ্ট্যালিন নিজেও এ কথা ১৯২৪ সালে প্রকাশিত “লেনিন ও লেনিনবাদ” নামক বইয়ে লিখেছিলেন।২২ এইমত পরিবর্তন করে তারা এক দেশে সমাজতন্ত্র স্থাপনের লক্ষ্য ঘােষণা করলেন। এর বিরােধীদের তারা দল থেকে বহিষ্কার করলেন। অনেককে দেশের দূরবর্তী অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আর ট্রটস্কীকে নির্বাসনে পাঠান হল।
এরপরও ১৯২৮ সালে দেশের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি নিপীড়নমূলক ছিল না। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সন্ত্রাস বিরােধী ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছিল। শান্তিকালীন পরিস্থিতি ফিরে এসেছিল, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা হচ্ছিল, সব ব্যাপারেই আইনের শাসন প্রচলন করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থনীতি নির্ভর করছিল কৃষি উৎপাদনের উপর। বড় কৃষকেরা (Kulak নামে পরিচিত) শহরে খাদ্যশস্য সরবরাহ করত কিন্তু তাদের চাহিদা মেটানর জন্য যথেষ্ট শিল্পদ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছিল না। ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি তারা শহরে খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানাল। এদিকে সােভিয়েত সরকারকে উৎখাত করার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত থেমে যায় নি। এই সময় গ্রেট বৃটেন ছিল সােভিয়েত রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সবচাইতে বড় অংশীদার। গ্রেট বৃটেন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বাণিজ্য বন্ধ করে দিল। সােভিয়েত রাশিয়া সংকটে পড়ল। দলে অস্থিরতা দেখা দিল। নেতাদের ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হল। দল দুই মতে ভাগ হয়ে গেল। বুখারিন ও তার সঙ্গীরা আগের নীতিতেই চলতে চাইল, এতে ধনী কৃষকদের হাতে আরও ক্ষমতা দিতে হত-আর আন্তর্জাতিক চাপের মােকাবিলা করার শক্তিও কমে যেত। ষ্ট্যালিন প্রথমদিকে দোদূল্যমান ছিলেন। কিন্তু তিনি কৃষকের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শস্য নিয়ে দ্রুত শিল্প কারখানা গড়ে তােলার নীতিগ্রহণ করলেন, যা ছিল ট্রটস্কীর নীতি। এ নীতির পক্ষে ছিল আমলারা আর শিল্প কারখানার ম্যানেজাররা। এরা অনেকেই তখন দলের সদস্য হয়ে গেছে। এই নীতির ফলে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলির মত বেশী সংখ্যক উন্নত ধরনের যুদ্ধাস্ত্র যেমন ট্যাংক, উড়ােজাহাজ, যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদি বানানও সম্ভব ছিল। ষ্ট্যালিন বললেন- আমরা উন্নত দেশগুলির চাইতে ৫০ বা ১০০ বছর পিছিয়ে আছি। দশ বৎসরের মধ্যে আমরা যদি তাদের সমকক্ষ হতে না পারি তাহলে তারা আমাদের ধ্বংস করবে।
যে সমস্ত শিল্প কারখানা অন্যান্য শিল্প কারখানার যন্ত্রপাতি তৈরী করতে প্রয়ােজন হয় সেগুলােতে বেশী বিনিয়ােগ করা শুরু হল। এই ধরনের উৎপাদনমূলক শিল্পে বিনিয়ােগ ১৯২৭-২৮ সালে ছিল ৩২.৮ শতাংশ তা ১৯৩২ সালে হল ৫৩.৩ শতাংশ, আর ১৯৫০ সালে হল ৬৮.৮ শতাংশ।৬ ভােগ্যপণ্য তৈরীর কারখানায় বিনিয়ােগ কমে গেল। ফলে কৃষকেরা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে যে ভােগ্য পণ্য পেত তা কমে গেল। ষ্ট্যালিনের সরকার কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য আদায় করার জন্য তাদের জমি অধিগ্রহণ করে “যৌথ খামার স্থাপন করল। লক্ষ লক্ষ ছােট ও মাঝারি কৃষকের জমি নিয়ে নেওয়া হল। এই নীতি জোর খাটান ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। জমি অধিগ্রহণে কৃষকদের চরম দুর্ভোগ হল। খাদ্যশস্য। নিয়ে নেওয়ার ফলে অনেকেরই খাদ্যাভাব হল। যারা প্রতিরােধ করল তাদের দমন করা হল। অনেককে দূর অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। শ্রমিকদের মজুরী আরও কমিয়ে দেওয়া হল-পাঁচ বছরে তাদের আয় আগের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গেল।২৭ শ্রমিকদের অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শ্রমিক সংগঠণগুলােকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হল। অনেক প্রতিবাদীকে নির্বাসনে | labour camp এ পাঠান হল। ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে নির্বাসনে labour camp এ পাঠান মানুষের সংখ্যা বিশগুণ বেড়ে গেল। আমলাতন্ত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এই নীতির সমালােচনা দমন করা হল। দলের মধ্যেও বিতর্ক বন্ধ করা হল। দ্বিমত পােষনকারীদের কারাগারে পাঠান হল। অনেককে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। ১৯২১ সালে যত মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৩৭ সালে তার চাইতে ৪০ গুণ বেশী মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। এটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল যখন লেনিনের সময়কার (১৯১৭ সাল) দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যে কয়জন সদস্য অবশিষ্ট ছিল তাদের ১৯৩৬-৩৭ সালে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল, ষ্ট্যালিন, কোল্লোনতাই ও ট্রটস্কী ছাড়া। আলেকজান্দ্রা কোল্লোনতাই তখন সুইডেনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন আর ট্রটস্কী ছিলেন নির্বাসনে। ১৯৪০ সালে ট্রটস্কীকে ষ্ট্যালিনের এজেন্টরা নির্বাসনে হত্যা করে। লেনিনের প্রদর্শিত নীতি ষ্ট্যালিন পরিচালনা করেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ১৯২০ সালে বলশেভিক দলের সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ছয়জনে একজন ১৯৩৯ সালে সােভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। বাকীদের অনেককে এমশিবির (labour camp) এ পাঠান হয়েছিল, অনেককে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল।
শিল্পোন্নয়নে পশ্চিমা দেশগুলির সমপর্যায়ে আসার জন্য ষ্ট্যালিন পুঁজি সংগ্রহের জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে মােট উৎপাদন কমে গেলেও সরকার যে অংশ নিতেন তা বাড়ান হল ।। লক্ষ লক্ষ কৃষক শহরে আসতে লাগল, তাদের কারখানার শ্রমিক হিসাবে কাজ করান গেল । শ্রমিকদের আয় কমিয়ে ও সুযােগ সুবিধার জন্য সংগঠন করার ক্ষমতা খর্ব করে আরও বেশী কাজ আদায় করা হল। বৃটিশ পুঁজিবাদ পুঁজি তৈরীর সময় তাদের কৃষকদের জমি নিয়ে, enclosure এর মাধ্যমে, শহরে আসতে বাধ্য করেছিল। তারাও শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ না করে দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা খাটাত, এমনকি নারী ও শিশু শ্রমিকদেরও। বৃটিশ পুঁজিবাদ ভারত, আফ্রিকা ও অন্যান্য উপনিবেশে লুটপাটের মাধ্যমে যে পুঁজি আহরণ করে দেশে আনত, রাশিয়া উপনিবেশ থেকে পুঁজি সংগ্রহের সুযােগ ছিল না। বৃটেনের পুঁজিবাদের অভূদয়ে প্রথমে ছােট ছােট শিল্প কারখানা কাজ শুরু করে কয়েকশত বৎসর ধরে বড় বড় শিল্পে রূপান্তর ঘটেছিল । ষ্ট্যালিনের সেই সময় ছিল না। সামরিক শক্তিতে পশ্চিমা দেশগুলির সমকক্ষ হতে হলে সেই দেশগুলাের মত বড় বড় শিল্প কারখানা ও অবকাঠামাে দর শিল্প কারখানা গুলােতে কৃষি উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আহরণ করে, শ্রমিকদের কঠিন শ্রম ও সমস্ত দেশের বিশাল দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে।৩০
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পর পর কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুরু করা হয় ১৯২৮ সালে। উদ্দেশ্য ছিল সােভিয়েত ইউনিয়নকে শিল্প, সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলা। প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়। অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চ লক্ষমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল, কয়েকটি ক্ষেত্রে যেমনঃ সামগ্রিক শিল্প উন্নয়ন শতকরা ২৫০ ভাগ বেশী, ভারী শিল্প উৎপাদন শতকরা ৩৩০ ভাগ বেশী। এ সত্বেও উল্লেখযােগ্য অর্জন হয়েছিলঃ
সূচক ইস্পাত উৎপাদন কয়লা উৎপাদন। জ্বালানী তৈল উৎপাদন বিদ্যুৎ উৎপাদন
১৯২৯ সাল। ৪ মিলিয়ন টন। ৩৫.৪ মিলিয়ন টন | ১১.৭ মিলিয়ন টন। ৫.০ বিলিয়ন কিলােওয়াট ঘন্টা
১৯৩২ সাল ৫.৯ মিলিয়ন টন ৬৪.৩ মিলিয়ন টন
২১.৪ মিলিয়ন টন ১৩.৪ বিলিয়ন কিলােওয়াট ঘন্টা
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এক বছর আগেই ১৯৩২ সালে সমাপ্ত করা হয়। এই পরিকল্পনার ফলে সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ভারী শিল্পে আরও অগ্রগতি আনে। ইস্পাত উৎপাদনে সােভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানীর কাছাকাছি চলে যায়। রেলপথ ও যােগাযােগ ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত ও কার্যকর হয়। তবে কয়লা ও জ্বালানী তেল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। ভারী শিল্প অগ্রাধিকার পাওয়ায় ভােগ্যপণ্য সরবরাহের পরিমাণ ও গুণগতমান কমে যায়। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ১৯৩৮ সালে শুরু হয় ও জার্মানী সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কারণে ১৯৪১ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বাড়ান হয় ও যুদ্ধ আক্রান্ত এলাকাসমূহের আরও পূর্বদিকে উরাল পর্বতমালার পর নতুন যুদ্ধাস্ত্র কারখানা গড়ে তােলা হয়। লক্ষমাত্রা সর্বক্ষেত্রে অর্জিত না হলেও পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রচেষ্টা বিপুল অর্জন এনে দেয়। ত্রিশের দশকে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছিল যার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
চতুর্থ ও পঞ্চম পরিকল্পনা ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত চলে। যুদ্ধে সােভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারী হিসাবে ৯৮ হাজার যৌথ খামার ধ্বংস হয়। ১৩৭,০০০ ট্রাক্টর, ৪৯,০০০ হারভেষ্টর (শস্য সংগ্রহের যন্ত্র) নষ্ট হয়, ৩৫ হাজার শিল্প কারখানা যা মােট শিল্প কারখানার ২৫ শতাংশ, ধ্বংস হয়। প্রায় ৭০,০০০ গ্রাম, ৪,৭০০ শহর (শহরের ঘর বাড়ীর প্রায় ৪০ শতাংশ) নষ্ট হয়। সরকারী হিসাবে প্রায় ৭৫ লক্ষ সৈন্য নিহত হয়, প্রায় সর্বমােট ২ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৯৪০ সালের তুলনায় ১৯৪৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমে যায়, ইস্পাত উৎপাদন কমে প্রায় ৪৫ শতাংশ, খনিজ উৎপাদন কমে ৪০ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদন কমে ৬০ শতাংশ। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ গৃহহারা হয়।
উৎপাদন ফিরিয়ে আনার পথে একটা বাধা হয় মানব সম্পদের স্বল্পতা। যুদ্ধে এত মানুষ মারা গিয়েছিল যে শ্রমিকের স্বল্পতা হয়ে গেল। ১৯৪৬ সালে খরা হওয়াতে কৃষি উৎপাদনও কম হল। ১৯৫২ সাল নাগাদ কৃষি উৎপাদন ১৯৪১ সালের সমান হল। তবে শিল্প উৎপাদন ১৯৫২ সালে ১৯৪১ সালের চাইতে দ্বিগুণ হল ।
পরিকল্পিত অর্থনীতির ফল
গৃহযুদ্ধে সােভিয়েত সরকার বিজয়ী হল, কিন্তু যুদ্ধকালীন অর্থনীতির ধারা আরও চালান যাবে, তার সম্ভাবনা ছিল না। কৃষকদের শস্য সামরিক প্রয়ােজনে নিতে থাকলেও শ্রমিকদের কঠোর শ্রমে নিয়ােজিত রাখলে বিদ্রোহ ঘটার সম্ভাবনা ছিল। বাস্তববাদী লেনিন এটা উপলব্ধি করে “যুদ্ধকালীন কমিউনিজম” থেকে সরে এসে তাঁর নিজের কথায় “রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ” চালু করলেন। এই সময় দ্রুত ও ব্যাপক শিল্পায়ন করার প্রয়ােজন সরকার অনুভব করলেন এবং এটা পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে সেটাও স্থির করা হল এবং এটাই সরকারের অগ্রাধিকার বলে গণ্য করা হল। কাজেই NEP চালু করা হলেও সামাজিক মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার উপায় হিসাবে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন নীতি হিসাবে গ্রহণ করা হল। ১৯২০ সালে বৈদ্যুতিকরণের জন্য পরিকল্পনা পরিষদ গঠন করা হল আর সামগ্রিক পরিকল্পনার জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিশন (GOSPLAN) ১৯২১ সালে স্থাপন করা হল, এবং সেটা সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া পর্যন্ত চালু ছিল।
কারখানার শ্রমিকগােষ্ঠী যারা ছিল বলশেভিক দলের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি, তারা অনেকেই গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, আর অনেকেই কারখানা থেকে প্রশাসনিক কাজে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। অনেক বিরােধিতার পর NEP গৃহীত হয়ে যখন তা বাস্তবায়িত হয় তখন তা ছিল সফল। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা হল । কিন্তু এবারও সােভিয়েত অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর পশ্চাদপদ অর্থনীতি। শতকরা ৮২ ভাগ মানুষ ছিল গ্রামবাসী। মাত্র শতকরা ৭.৫ ভাগ কৃষির বাইরে কর্মরত ছিল। এই ব্যাপক কৃষক শ্রেণী কি উৎপাদন করত, কতটা বিক্রি করতে চাইত, বিনিময়ে কি কিনতে চাইত এটাই ছিল অর্থনীতির বড় বিষয়। রাষ্ট্রের আয় ছিল মূলত কৃষি উৎপাদন ভিত্তিক, কাজেই বিনিয়ােগের উৎসও ছিল কৃষির উদ্বৃত্ত। কৃষকের উদ্বৃত্ত আহরণ করতে না পারলে শিল্পে বিনিয়ােগ করার সম্পদ ছিল না। আবার শিল্প উৎপাদন না বাড়ালে কৃষকরা উদ্বৃত্ত শস্য শহরে বিক্রি করতে চাইত না। কাজেই NEP এর নীতি চলতে থাকলে শিল্পে বিনিয়ােগ খুব বেশী বাড়ান সম্ভব ছিল না। NEP অথবা এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু রাখা সম্ভব হলেও শিল্পায়ন হত ধীরগতিতে। ১৯২৮ সালের পর যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ছকে শিল্পায়ন হাতে নেওয়া হল তাতে বিনিয়ােগের সম্পদ ছিল কৃষি উদ্বৃত্ত। কৃষকদের জমি বাধ্যতামূলকভাবে অধিগ্রহণ করে যৌথ খামারে রূপান্তরিত করা ও শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে বাধ্য করা ছাড়া ঐ সময় সােভিয়েত ইউনিয়নে দ্রুত শিল্পায়ন করার বিকল্প পথ ছিল না। দ্রুত শিল্পায়নের জন্য যে নীতিই নেওয়া হত না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর ব্যাপক কৃচ্ছতাসাধন চাপিয়ে দেওয়া নির্মমতা ছাড়া সম্ভব ছিল না।৩২ এটাও ছিল এক ধরনের যুদ্ধাবস্থার অর্থনীতি (war economy) এবং এর বাস্তবায়ন ছিল অনেকটা সামরিক অভিযানের মতই। লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হত এবং তা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলােতে পর্যন্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হত। এই অঞ্চলগুলাে ছিল ব্যাপক এলাকায় বিস্তৃত, ককেশাস পর্বতমালা হতে মধ্য এশিয়া ও সাইবেরিয়া পর্যন্ত ছড়ান। কম শিক্ষিত অভিজ্ঞতাহীন কৃষিকাজে অভ্যস্ত মানুষদের দিয়ে প্রথমে কাজ শুরু হয়। এরপর কারিগর, কৃষিবিদ ও প্রশাসকদের দ্বারা বাস্তবায়ন করতে হত। সর্ব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হত কেন্দ্রে, ফলে একটা বিশাল আমলাতন্ত্র তৈরী হল, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাস্তবায়নে-এবং সাথে সাথে সরকারী কর্মকান্ডের সব ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে (ত্রিশের দশকের শেষ দিকে) ষ্ট্যালিনের চেষ্টা সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের আধিপত্য কমে নাই। উপরন্ত তা অন্যান্য ক্ষেত্রে বৃদ্ধির চাইতে প্রায় আড়াইগুণ বেশী হারে বেড়েছিল। এই ব্যবস্থার আর একটা দুর্বলতা ছিল এর অনমনীয়তা। নির্ধারিত মান ও সংখ্যার দ্রব্য উৎপাদনে এই ব্যবস্থা ছিল খুবই কার্যকর। কিন্তু উদ্ভাবন, গুণগত মানের পরিবর্তন বা এ সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার কোন ব্যবস্থা এতে ছিল না। কোন নতুন আবিষ্কার হলে তা কাজে লাগানর কোন ব্যবস্থাও ছিল না। ভােক্তাদের পছন্দ-অপছন্দ জানানরও কোন প্রক্রিয়া ছিল না। ভারী শিল্পের উপর উৎপাদন ব্যবস্থা জোর দিয়েছিল- তা চলতেই থাকল। অর্থনীতির আকার বাড়ার কারণে ভােগ্যপণ্য উৎপাদনও কিছু বাড়ল। কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করা হয় নি। সেবামূলক ক্ষেত্রগুলােও উন্নত করা হয় নি। কৃষিতে উন্নতি শিল্পখাতের চাইতে ছিল অনেক কম, যদিও শিল্পের উন্নতি ছিল কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে। কৃষিতে করের হার ছিল বেশী। যখন কৃষি জমি যৌথ খামারে রূপান্তর করা হল, কৃষি উৎপাদন কমে গেল, গৃহপালিত পশুর সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেল। এজন্য ১৯৩২-৩৩ সালে বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ১৯৪০ সালে যৌথ খামারে রূপান্তরের আগের অবস্থায় ফিরে আসে নি, ব্যাপক যান্ত্রিক পরিবর্তনের (mechanization) পরেও উৎপাদন ততটা বাড়েনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসে কৃষি উৎপাদন স্বভাবতই কমেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অল্প সময়ের জন্য কৃষি উৎপাদন বেড়েছিল, সামান্য রপ্তানী করা সম্ভব হয়েছিল। বিপ্লবের আগে জারের আমলে রাশিয়া বড় খাদ্য শস্য রপ্তানীকারক ছিল, খাদ্য শস্যের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন আমদানী নির্ভর হয়ে পড়ল। ১৯৭০ এর দশকে প্রায় এক চতুর্থাংশ খাদ্য আমদানী করতে হত। সােভিয়েত কৃষি ব্যবস্থা ছিল ব্যর্থ, কিন্তু এটাকে যৌথ খামার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ফল বলা যায় না। ১৯৮০ এর দশকের প্রথমভাগে হাঙ্গেরী প্রায় সম্পূর্ণ যৌথ খামারে রূপান্তরিত কৃষিব্যবস্থা থেকে ফ্রান্সের চাইতে বেশী কৃষিপণ্য রপ্তানী করত, যদিও হাঙ্গেরীর জমির পরিমাণ ফ্রান্সের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ ছিল।
তবুও সােভিয়েত সমাজব্যবস্থা জনগণের সামাজিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হল। জনগণ কাজ, খাদ্য, ও আবাস সবই নিয়ন্ত্রিত মূল্যে পেত। অবসর ভাতা, স্বাস্থ্য সেবাও তখনকার অবস্থা অনুযায়ী সবাইকে দেওয়া হল। সর্বোপরি সবাইকে শিক্ষা দেওয়া হল। একটা বড় অশিক্ষিত জনগােষ্ঠীর দেশকে আধুনিক সােভিয়েত ইউনিয়নে পরিণত করা ছিল একটা বিশাল অর্জন। লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত কৃষক, যাদের ভাগ্যে ছিল সারা জীবন গ্রামে থেকে আদিম উপায়ে কৃষিকাজ করে যাওয়া, তারা সােভিয়েত ইউনিয়নের সবচাইতে খারাপ সময়েও শহরে এসে শিক্ষার সুযােগ, কাজের সুযােগ ও নতুন জীবন গড়ার সুযােগ পেয়েছিল । দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বিশেষতঃ ১৯৩০ এর দশকে সােভিয়েত ইউনিয়নে অর্থনৈতিক উন্নতির হার পৃথিবীর সমস্ত দেশের চাইতে বেশী ছিল (জাপান ছাড়া)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও প্রথম ১৫ বছর সােভিয়েত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলাের চাইতে অনেক বেশী ছিল। নিকিতা ক্রুশ্চেভ সহ অনেক সােভিয়েত নেতা। তখন মনে করতেন অদূর ভবিষ্যতে সােভিয়েত অর্থনীতি পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলােকে ছাড়িয়ে যাবে। কোন কোন পশ্চিমা নেতাও (যেমন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান) একই মত পােষণ করতেন। একটি পশ্চাদপদ ও কৃষি নির্ভর বৃহৎ দেশ তাদের গৃহীত নীতির ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যেই একটা শিল্পোন্নত অর্থনীতিতে উন্নীত হল। সেই সময় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পোন্নত দেশ জার্মানী (বৃটেন ছিল প্রথম) সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে একটা বড় এলাকা দখল করে নিল, যেখানে সােভিয়েত ইউনিয়নের এক তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করত। আক্রমণের ফলে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে গেল। এরপরও অন্যান্য মিত্রদেশের যথেষ্ট সাহায্য ছাড়াই প্রায় এককভাবে জার্মানীর মূল সমর শক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হল সােভিয়েত ইউনিয়ন। যে অতুলনীয় কষ্ট, প্রাণহানি, ও ত্যাগ সােভিয়েত জনগণ সেই সময় করেছিল এবং ত্রিশের দশকের শিল্পোন্নয়নের সময়েও করেছিল) তা অন্য কোন সরকার ক্ষমতায় থাকলে সম্ভব হত কিনা তা অনেকেই সন্দেহ করেন।
তথ্য সূত্র:
- Trotsky L. The History of Russian Revolution. London, 1965 p 121 . Harman C. A People’s History of The World. London, 2008 p 413 9. Harman C. p 420 8. Harman C. p 424 Q. Hobsbawm E. The Age of Extremes. New York, 1994 p 376 Y. Harman C. p 422 9. Lenin VI, Collected Works. Vol-8. Moscow, 1962 p 28 b. http://en.wikipedia.org/wiki/Treaty-of-Brest-Litovsk, accessed 12 May 2013 d. Smith SA. Red Petrograd. Cambridge, 1983 p 10 so. Harman C. p 426 Ss. Hobsbawm E. p 63 3. Serge V. Year One of the Russian Revolution. London, 1992 p 282 so. Serge V. p 265 38. Harman C. p 428 se. Hobsbawm E. p 64, 65 sy. Koenker DP, Rosenberg WG, and Suny RG(ed).Party, State and Society in the Russian Civil
War. Bloomington, 1989 p 61 39. Kenez P. A Histoery of The Soviet Union from the Beginning to the End. Cambridge, 2006, p 48 36. http://en.wikipedia.org/wiki/ Five_Year_Plan_for_the_National_Economy_of_the_Soviet
Union accessed 20 May, 2013 ss. Siegelbaum LH. Soviet State and Society Between Revolutions 1915-1929. Cambridge, 1992 p 35 10. http://en.wikipedia.org/wiki/ New Economic Policy accessed 20 May 2013 33. Harman C. p 47 **. Harman C. p 473 20. Reiman M. The Birth of Stalinism: the USSR on the Eve of the “Second Revolution”. London,
1987, p 2 18. Harman C. p 475 16. Deutscher I.Stalin. London, 1961 p 328 Ry. Cliff T. Russia: A Marxist Analysis. London, 1964 p 33 39. Cliff T. State Capitalism in Russia. London, 1988 p 53 26. Harman C. p 477 10. Cliff T. State Capitalism. p 130 vo. Harman C. p 478 os. Hobsbawm E. p 378 Os. Hobsbawm E. p 380 9o. Hobsbawm E. p 377 08. Milward A. War, Economy and Society. London, 1979 p 92
সাম্প্রতিক মন্তব্য