ত্রিশ লক্ষ শহিদ : বাহুল্য নাকি বাস্তবতা

বাঙালি বড় বিস্মৃতি পরায়ণ জাতি। নিজেদের ইতিহাস ভুলে বসে থাকে। কখনো বিকৃতও করে অহর্নিশি। বাঙালি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিয়ে … এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করে না। বিষয়টা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের, এবং অস্বস্তিরও।

বাঙালি জাতির এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সবচেয়ে বড় গর্বের ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস জানা আমাদের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন বিবিধ অপপ্রচারের সঠিক জবাব দেয়ার। সেই প্রেরণা থেকেই কলম তুলে নিয়েছেন তরুণ মেধাবী লেখক আরিফ রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বোধ করি শহীদের সংখ্যা নিয়ে। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে নাকি ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা যায়নি, শেখ মুজিব নাকি মিলিয়ন এবং লক্ষের পার্থক্য না বুঝে গুলিয়ে ফেলেছিলেন, তাই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সাংবাদিকদের কাছে নাকি শহীদের সংখ্যা ভুলক্রমে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন। এটাই প্রচলিত মিথ হিসেবে, অপপ্রচার হিসেবে বহুদিন অনলাইনে রাজত্ব করেছে। অনেকে আবার মনে করে নয় মাসের যুদ্ধে পাকবাহিনীর পক্ষে এতো মানুষ মেরে ফেলা সম্ভব ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে লেখালিখির কারণে এ ধরণের নানা অপপ্রচারের সাথে কিছুটা পরিচয় আছে আমার। আমার পরিচালিত মুক্তমনা ব্লগে ব্লগার আবুল কাশেম ‘The Mathematics of a Genocide’ নামের একটি প্রবন্ধে এ সমস্ত অপপ্রচারের একটি বলিষ্ঠ উত্তর দিয়েছিলেন সেই ২০০২ সালের দিকেই। বাংলায় লেখাটির একটি ভাবানুবাদ করেছিলেন ব্লগার যুঞ্চিক্ত; তার ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ – মিথ নাকি বাস্তবতা?’ শিরোনামের লেখাটি প্রথমে সামহোয়্যারইন ব্লগে এবং পরবর্তীতে মুক্তমনা এবং শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের মুখপত্র মুক্তান্বেষা ম্যাগাজিনে (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। দীর্ঘদিন ধরে এ লেখাগুলোই মূলত এ ধরণের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত। তবে এর মধ্যে জামানা বদলেছে অনেকে। অপপ্রচারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নানা কুযুক্তি। রঙ্গমঞ্চে এসেছে শর্মিলা বোসের মত কিছু জ্ঞানপাপী যারা মনে করেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী, পাকিস্তানী, বিহারী সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ নাকি মারা যায়নি। শর্মিলার মতে, বাংলাদেশ নাকি ধর্ষিতাদের সংখ্যা নিয়েও প্রবল রাজনীতি হচ্ছে। পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস এবং ডন পত্রিকায় এই ‘বিশেষজ্ঞের’ বরাত দিয়ে একসময় বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের যুদ্ধে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নি’, কিংবা হলেও দু চারটি হয়তো হয়েছে – হাজার হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ নয় (রেফারেন্স – Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War, P-3870)। আরিফ বিস্তর সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করে দেখিয়েছেন কিভাবে এবং কতরকম ভাবে শর্মিলা বসু মিথ্যাচার করেছেন। তিনি হাজির করেছেন কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, চীন সহ বিভিন্ন দেশের গণহত্যার পরিসংখ্যান এবং তার সাথে উপস্থাপন করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তুলনামূলক খতিয়ান, ডেমোগ্রাফির ডেটা থেকে পাওয়া চার্ট, শরণার্থী শিবিরের তথ্য থেকে শুরু করে বীরাঙ্গনাদের জবানবন্দি পর্যন্ত অসংখ্য তথ্য এবং রেফারেন্স সহযোগে দেখিয়েছেন এ সমস্ত অপপ্রচার এবং কুযুক্তির ভিত্তি আসলে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য।

এ গ্রন্থটি কেবল শহীদের সংখ্যা নিয়ে অপপ্রচারেরই শক্ত জবাব নয়, সেই সাথে অন্য অনেক প্রচলিত কুযুক্তির যৌক্তিক খণ্ডনের সন্নিবেশ। যেমন, গ্রন্থটির শেষ দিকে আরিফ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করেছেন, একটি হচ্ছে ‘কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ অনুসন্ধান’ এবং অন্যটি ‘ভাষাসৈনিক গোলাম আযম’: একটি গোয়েবলসীয় প্রচারণার ব্যবচ্ছেদ’। লেখা দুটো প্রকাশিত হয়েছিল জনপ্রিয় অনলাইন বাংলা পত্রিকা বিডিনিউজ২৪ ডট কমে, এবং ঘটনাক্রমে আমি ছিলাম প্রবন্ধ দুটোর সহলেখক। এ প্রবন্ধ দুটো লেখার সময় আমি কাছ থেকে দেখেছি আরিফের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিষ্ঠা, মমতা, আবেগ এবং বিশ্বস্ততা। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তার মতো প্রজন্মের হাত দিয়েই যেন রচিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়। তরুন লেখক আরিফের এ বইটি ঘোর অমানিশায় আলোকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করবে, এই আশা মোটেই বাতুলতা নয়।

– অভিজিৎ রায়।

 

ত্রিশ লক্ষ শহিদ : বাহুল্য নাকি বাস্তবতা

আরিফ রহমান

বইটি পড়তে অনুগ্রহ করে নিচের লিংকে ক্লিক করুন, ধন্যবাদ

https://doc.liberationwarbangladesh.net/books/behf/#p=1

 

 

You may also like...