রুব আল খালির দাবেরী, লায়লা আর জাররা কাহিনি [পর্ব : ২]
আল ফিররাহ জনবসতির কুড়ি বাইশজন পুরুষ এলো নামাজে সামনে। অনেকের গা খালি। কেবল নিম্নাঙ্গে একটা চাঁদরের মত পরা সাদা রঙয়ের। কোমরে একটা বড় চাকু গোজা চামড়ার খাপে। পেছনে দশ বারোজন নারী। তারা সবাই কালো হিজাব পরা। কারো মুখই দেখা গেল না। দেখলাম নারী পুরুষ একই জামাতে নামাজ পড়ে। তবে পুরুষের কাতার থেকে বেশ পেছনে দাঁড়ায় নারীর গ্রুপ। বেশ গরম মসজিদের ভেতরে। এতো গরমে নারীরা কিভাবে বোরকা পরে থাকে, চিন্তা করে বিস্মিত হলাম আমি। নামাজ শেষ হলে দুই মহিলার সাথে কথা বললো দাবেরী। মহিলারা চলে গেলে আমার কাছে এসে বললো – “খাবার খাবে না”? বললাম – “হ্যাঁ খাবো, কিন্তু কিছুতো চিনিনা আমি”! দাবেরীর সাথে কাছের একটা ঘরে গেলাম। সেখানে খবুজ বা রুটি বানায় এক স্থানীয় বদু। সেখান থেকে ৩-রিয়ালে ১২-টা রুটি কিনলো দাবেরী। আমার হাতে রুটি দিয়ে বললো – “এখান থেকে ডেইলি রুটি কিনে নেবে। এটাও তোমার কাজ”! আমি দাবেরীর পিছু পিছু গেলাম ওর ঘর পর্যন্ত। কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকতে দিলো না আমাকে। হেসে বললো – “বেগানা পুরুষদের ঘরে ঢোকা নিষেধ। তুমি বাইরে দাঁড়াও”। রুটি নিয়ে ভেতরে গেলো দাবেরী। একটা থালাতে দুটো রুটি আর মাংস দিয়ে বললো – “তুমি এখানে বসে খাও। আমি ভেতরে খাবো স্ত্রী কন্যাদের সাথে”! আমি বললাম – “কিন্তু এ বালির মধ্যে আমি বসবো কিভাবে”? দাবেরী ঘরের পাশে রাখা একটা পুরনো ছেঁড়া কার্পেট মাটিতে বিছিয়ে বললো – “এখানে বসো। আমিও আমার খাবার নিয়ে আসছি”! খাবার নিয়ে এসে দাবেরীও খেলো আমার সাথে। শেষ হলে জল খেতে যেতে হলো আবার ঐ কুয়ার কাছে। জল তুলে খালি প্লাস্টিকের বোতলে ভরে জল খেলাম দুজনে।
:
আমাকে বাইরে ছেঁড়া কার্পেটে বসিয়ে দাবেরী গেল ঘরের ভেতরে। ফিরলো প্রায় দুঘন্টা পর। এসে বললো – “একটু বিশ্রাম করলাম। চলো এবার আমার মাজরাহ-তে যাই”। ওর সাথে প্রায় আধাঘন্টা হেঁটে পৌছলাম দুই পাহাড়ের মাঝের একটু সমতল ভূমিতে। সেখানে চারদিকে পাথর সরিয়ে বালুময় কৃষি জমি বানিয়েছে দাবেরী। ওপরের পাহাড় থেকে চিকচিকে সামান্য জল আসে পাথর চুইয়ে। তাতে শশা, ভুট্টা, আলু, নানাবিধ সব্জি চাষ করেছে দাবেরী। আমাকে ক্ষেতের কোণে একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বললো – “এখানে কাজ করবে, আর ঐ ঘরটাতে থাকবে তুমি রাতে”! খামার দেখা হলে আবার নিজ বসতির কাছে ফিরে এলো দাবেরী। ঘরের একটু অদূরে ১০/১২টা উট দাঁড়িয়ে। সেখানে বড় সাইজের ইটের ব্লক দিয়ে বানানো একটু ঘরের মত। তাতে ৪০/৫০-টা ছাগল আর দুম্বা রাখা। আঙুল দিয়ে সেগুলো দেখিয়ে বললো – “এগুলোও আমার। তোমাকে এগুলোও দেখতে হবে”! উট আর ছাগলের গন্ধে ওখানে দাঁড়াতে পারছিলাম না আমি। মনে হচ্ছে এখনই বমি করে দেব। কিন্তু আমি এসেছি এ বেদুঈনদের জীবনাচার দেখতে। তাই সব কিছুতেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম আমি। দাবেরী আর আমি পশুগুলোকে নিয়ে গেলাম নিচু মরুদ্যানের কাছে। সেখানে বাবলা জাতীয় কাঁটা গাছের পাতা খেতে থাকলো পশুগুলো। কিন্তু বিকট গন্ধ এদের। কখনো স্নান করানো হয়নি এ মরু পশুগুলোকে এ জীবনে। তাই গন্ধে টেকা দায়।
:
সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আমি আর দাবেরী কাটালাম পশুগুলোর সাথে। গরমে মনে হয় গায়ের চামড়া পুরে যাবে। তাই সার্ট-প্যান্ট খুলে দাবেরীর মত বেদুঈন পোশাক পরবো কিনা চিন্তা করতে থাকলাম। সন্ধ্যার আগেই আমরা উট আর ছাগলগুলো নিয়ে এলাম ওর ঘরের পাশের গোয়ালঘরে। সব পশু ঘরে ঢুকলে দাবেরী জোরে ডাক দিলো ‘উম্মি ফাতিমা, উম্মি জাররা’ বলে। দুটো মেয়ে এলো ৬-টা বাটি জাতীয় বড় পাত্র নিয়ে। একটা মেয়ে বড়, বোরকায় তার মুখ ঢাকা। অন্য মেয়েটি ৯/১০ বছরের। সম্ভবত এর নামই ফাতিমা। বড় মেয়েটি দূরে দাঁড়িয়ে রইলো হাতের পাত্র মাটিতে রেখে। ছোট মেয়েটি পাত্রগুলো নিয়ে এলো দাবেরী আর আমার কাছে। প্রথমে চারটে উট, তারপর ১৪/১৫-টা ছাগল দোহন করলো দাবেরী। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি দুধ দোহাতে পারি কিনা। মাথা নেড়ে বললাম – “পারিনা, তবে তুমি শেখালে পারবো”! দাবেরী ঠোঁট উল্টে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললো – “দুধ দোহাতে পারোনা? কি বলো? আমার এ ছোট মেয়ে ফাতিমাও দুধ দোহাতে জানে”! কাছে দাঁড়ানো ফাতিমাকে বললো – “মা, ঐ ছাগলদুটোর দুধ দোহাও তো”! ফাতিমা বাবার কথামত ছাগলের বাট টানতে থাকলো। ৬-পাত্রে দুধ ভরা হলে প্রথমে নিজে এক টানে প্রায় এক বাটির অর্ধেক দুধ খেয়ে ফেললো দাবেরী। মেয়ে ফাতিমাকে খেতে বললো। এরপর বাকিটুকু বললো আমাকে খেতে। কিন্তু মুখের কাছে নিয়ে উটের কাঁচা দুধের গন্ধে বমি এলো আমার। আমি একটুও খেতে পারলাম না। তা দেখে শব্দ করে হাসলো দাবেরী, তার ছোট কন্যা ফাতিমা আর দূরে দাঁড়ানো বড় মেয়েটি। দুবাটি দুধ নিয়ে ভেতরে গেলো মেয়ে দুটো। বাকি ভরা চার বাটি নিয়ে আমি আর দাবেরী চলে গেলাম সেই রুটির দোকানের কাছে। সেখানে দাবেরীর মত আরো দুজনে এসেছে দুধ বিক্রি করতে। কিন্তু অল্প সময়েই ৭/৮ জন বেদুঈন পুরুষ পাত্র নিয়ে এসে নিয়ে গেল সমস্ত দুধ। কেউ টাকা দিলো না। বুঝলাম তারা হয়তো পার্মানেন্ট কাস্টমার দাবেরীর। আমাকে দেখে জানতে চাইলো আমি কে? দাবেরী বললো – তার নতুন আমেল বা কর্মচারী। আগত সব পুরুষরা হাত মেলালো আমার সাথে। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো নানাবিধ আরবি কথায়।
:
আবার রাতে লাল ভাত আর মাংস খেলাম বাইরের ছেঁড়া কার্পেটে বসে। খাওয়া শেষ হলে দাবেরী বললো – “খামারের ঐ ঘরে ঘুমাতে হবে তোমার। যেতে পারবে চিনে”? নতুন আমি পথঘাট চিনিনা। প্রায় ৩০-মিনিট দূরত্বের ঐ খামার এখন যে কোথায় বুঝতে পারছিনা আমি এই রাতে। দাবেরীকে বললাম – “চিনতে পারবো না আমি। আচ্ছা ওখানে থাকবো কেন? তোমার ঘরে কি যায়গা নেই”? হেসে দাবেরী বললো – “ঘরে যায়গা আছে আমার! কিন্তু বহিরাগত পুরুষকে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারিনা আমরা। এটা এ সমাজের রীতি”! কি আর করা! দাবেরীকে সাথে নিয়ে আবার হেঁটে চললাম সেই খামারের দিকে। অনেকদিন এ ঘরে থাকেনি কেউ। দরজাটা ভাঙা ও খোলা। ভেতরে একটা কাঠের চারপায়া। তার ওপরে একটা ময়লা কালো পশমের কম্বল ও ছেঁড়া বালিশ। দাবেরীর হাতে একটা ছোট্ট টর্চ। সেটা ফেলে সে বিছানাটা দেখালো আমাকে। বাকিটা অন্ধকার। আমাকে অন্ধকারে রেখে চলে যাচ্ছে দেখে বললাম – “টর্চটা দিয়ে যাও আমাকে। আমার ভয় করছে একাকি”। দাবেরী আমার কাধে হাত রেখে বললো – “কিসের ভয়? তুমি রাজ্জাল (পুরুষ) না”? কি আর করা! আমাকে একা এ মরুভূমিতে রেখে চলে গেলো বুড়ো দাবেরী।
[পরের পর্ব কাল]
সাম্প্রতিক মন্তব্য