নিহন্তা ধর্ম প্রথমটুকু
Richard Dawkins – Christopher Hitchens Tribute
‘A lesser man would have seized the excuse of a mortal illness to duck responsibility and take it easy.’ Richard Dawkins on Christopher Hitchens
ধর্মের প্রতি তার বিতৃষ্ণা, মুলতঃ এই শব্দটার সাথে যে ধারনাটা জড়িত সেই অর্থেই, লুক্রেশিয়াস এর যেমন ছিল ঠিক সেধরনের। তিনি একে শুধুমাত্র মানসিক বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট হওয়া কোন অনুভুতি মনে করতেনা, বরং বিষয়টিকে মহান নৈতিকতা বিরুদ্ধে একটি অপশক্তি হিসাবেও দেখতেন। প্রথমত: , কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী রচনা করে একটি ভিত্তি তৈরী করে এবং–ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনা, ভক্তিমুলক অনুভুতি এবং উৎসবের অতি আতিশায্য, মানব জাতির কল্যাণের সাথে সম্পর্কহীনতা –এই সবকিছুকে সত্যিকারের কোন গুনাবলীর বদলে বিকল্প হিসাবে মেনে নেবার জন্য বাধ্য করে এর অনুসারীদের: কিন্তু সর্বোপরি ধর্ম, নৈতিকতার মানদন্ডকে কাঠামোগত সংস্কার করার মাধ্যমে, এটিকে কোন একটি মহান সত্ত্বার ইচ্ছার অধীনে কাজ করার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে, যে সত্ত্বাকে নিয়ে প্রশংসা এবং গুনগানের সত্যি কোন ঘাটতি রাখা হয়নি, কিন্তু সংযমী আত্মনিয়ন্ত্রিত সত্যের আলোকে এসব কিছু তাকে প্রতীয়মান করে তোলে উল্লেখযোগ্যভাবে ঘৃন্য একটা সত্ত্বা হিসাবে। জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill on his father, in the Autobiography )
কি ভয়াবহ অশুভ কাজ করার জন্য মানুষ প্ররোচিত হয় ধর্ম দ্বারা– লুক্রেশিয়াস (Lucretius, De Rerum Natura)
(ভুমিকা: ক্রিষ্টোফার হিচেন্স এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় রিচার্ড ডকিন্স এর কোন একটি লেখার মাধ্যমে। হিচেন্স সম্বন্ধে সবারই কোন না কোন ধরনের মতামত হয়ত আছে, তবে দুরারোগ্য ক্যান্সারটি ছাড়া তার যোগ্য কোন প্রতিপক্ষই ছিল না। নির্লিপ্তভাবে তিনি কিছু দিন আগে বলেছিলেন, আমাকে একটু আগেই পার্টি থেকে চলে যেতে হচ্ছে। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের চিন্তার জগত,পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সব তথাকথিত সত্যকে নির্মোহ আর চুলচেরা বিশ্লেষনের সাহসী ঐতিহ্যটাকে ধারন করে। অনাগত ভবিষ্যত চিরকৃতজ্ঞ থাকবে এই অসাধারন মানুষটির কাছে। ২০০৭ সালে মে মাসে হিচেন্স তার God Is Not Great: How Religion Poisons Everything প্রকাশ করেন। নীচের লেখাটি সেই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায় Religion Kills এর আমার একটি অনুবাদ প্রচেষ্টা মাত্র। লেখাটি উৎসর্গ করছি মুক্তমনার বুদ্ধিদীপ্ত সবাইকে, যাদের অনেকেরই ধর্মবিশ্বাসের অসারতা বুঝতে কখনো হিচেন্স পড়তে হয়নি অথচ ভবিষ্যতে পথে হিচেন্সের আলোকবর্তিকা এখন তাদের হাতেই। লেখাটি দুটি পর্বে আসছে, আজ রইল এর প্রথম পর্ব)
কল্পনা করুন, আপনি এমন কোন একটা কিছু করতে পারেন, যা আমি করতে অক্ষম।
অন্যভাবে যদি বলি, কল্পনা করুন, আপনি একজন অসীম দয়াময়, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করতে পারেন, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করার জন্য পুর্ব পরিকল্পনা করেছেন, তারপর আপনাকে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরীও করেছেন এবং আপনাকে এমন একটি পৃথিবীতে জীবন ধারন করার সুযোগ করে দিয়েছেন, যা শুধু আপনার জন্যই তিনি তৈরী করেছিলেন এবং এখনও আপনার ভালো মন্দ, সবকিছু তিনি দেখা শোনা করছেন, এমনকি আপনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখনও । আরো খানিকটা কল্পনা করুন, ভালোবেসে তিনি যে নিয়মকানুন এবং আদেশ বা নিষেধ সমুহ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি যদি তা মেনে চলেন, তাহলে অনন্তকালের জন্য প্রচন্ড সুখ আর শান্তিময় বিশ্রাম এর পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হবার সব যোগ্যতা আপনি অর্জন করবেন। আমি বলছি না, এই বিশ্বাসের জন্য আমি আপনাকে ঈর্ষা করছি (কারন আমার কাছে মনে হয়, এটা একটা ভয়াবহ ধরনের কল্যাণকামী এবং অপরিবর্তনযোগ্য কোন একনায়কতন্ত্রের জন্য কামনা করা); কিন্তু আমার একটা আন্তরিক প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। কেন এই ধরনের বিশ্বাস, যারা বিশ্বাসী তাদেরকে সুখী করতে ব্যর্থ হচ্ছে? তাদের কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে যে, এক অপুর্ব বিস্ময়কর গোপন সত্য তারা জানতে পেরেছেন, জীবনের সবচেয়ে প্রতিকুলতম মুহুর্তেও যার উপর তারা আস্থা রাখতে পারেন।
আপাতদৃষ্টিতে উপরে উপরে কখনো মনে হতে পারে এটাই হয়তো আসল পরিস্থিতি। আমি সাদা এবং কালো, দুই ধরনের সমাজেই তাদের ইভানজেলিষ্টদের সার্ভিসগুলোতে গিয়েছি। যেখানে পুরো ঘটনাই মহাপাপ থেকে রক্ষা পাবার, ঈশ্বরের ভালোবাসা এবং এরকম আরো অনেক কিছু পাওয়ার তীব্র আনন্দর সুদীর্ঘ একটা আত্মচিৎকার মাত্র। ধর্মের এ ধরনের নানা মাত্রার বহু আচার অনুষ্ঠান এবং সবগুলোই প্রায় প্যাগানদের মত, ঠিক এমনভাবে পরিকল্পিত, যা সামাজিক উৎসব পালনের আমেজ তৈরী করে; আর ঠিক সেকারনেই আমি অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে সন্দেহ পোষন করি। অবশ্য এছাড়াও আরো সংযত, ভদ্র আর পরিশীলিত মুহুর্তও আছে। আমি নিজে যখন গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য ছিলাম, আমি অনুভব করতে পারতাম- যদিও কোনদিন বিশ্বাস করতে পারিনি- আনন্দপুর্ন শব্দগুলো যা ইস্টারের দিন সকালবেলা বিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যে বিনিময় করতো: ‘Christos anesti!’ ( খৃষ্ট পুনরোজ্জীবিত হয়েছেন) , ‘Alethos anesti!’ ( সত্যি তিনি পুনরোজ্জীবিত হয়েছেন!);একসময় আমি গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য ছিলাম, আমি বলা উচিৎ, তার একটা কারন আছে, যা হয়তো আমার মত অনেকের ক্ষেত্রে, ধর্মের প্রতি তাদের বাহ্যিক আনুগত্য দাবী করার বিষয়টিকেও ব্যাখ্যা করে। অর্থোডক্স চার্চে যোগ যেমন আমি যোগ দিয়েছিলাম আর গ্রীক শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সন্তুষ্ট করার জন্য। যে বিশেষ দিনে এবং যে আর্চবিশপ, গ্রীক অর্থোডক্স কমিউনিয়নে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন করার অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন,সেই একই দিনে তিনি আমার বিয়েটাও পরিচালনা করেন, এভাবে তিনি একটার বদলে, দুটো অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক পকেটেস্থ করেছিলেন। পরে এই লোকই তার সহধর্মাবলম্বী সার্বিয়ার গনহত্যাকারী অর্থোডক্স সার্ব রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচ, সারা বসনিয়া জুড়ে যারা অসংখ্য গণকবর পুর্ন করেছিল নিরীহ নারী পুরুষ আর শিশুর লাশ দিয়ে, তাদের একজন খুবই উৎসাহী সমর্থক এবং তাদের উদ্দেশ্যর পক্ষে অর্থসংগ্রহকারীর ভুমিকাও পালন করেছিলেন। এর পরের বার অবশ্য আমি যখন বিয়ে করি, সেটি পড়িয়েছিলেন সংস্কারপন্থী, আইনস্টাইন এবং শেক্সপিয়ার ঘেষা একজন ই্হুদী র্যাবাই, বিয়ের আনুষ্ঠিকতা পরিচালনাকারী এই ব্যক্তির সাথে আমার সামান্য খানিকটা মিল ছিল। কিন্তু এমন কি তারও অজানা ছিল না যে, তার সারাজীবনের সমকামীতা, তার ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে নীতিগতভাবে খুবই গুরুতর অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত এবং যা পাথর ছুড়ে হত্যা করার মত শাস্তিযোগ্য। আর আমি যে অ্যাঙ্গলিকান চার্চে মুলতঃ ব্যাপটাইজড হয়েছি তা আজ হয়তো নীরিহ ভেড়ার মত মনে হতে পারে, কিন্তু তা এমন এক চার্চের উত্তরসুরী, যা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এবং বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সাথে যার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, এবং যার ঐতিহাসিক দ্বায়িত্ব ছিল ধর্মযুদ্ধ বা ক্রসেড পরিচালনা করা, ক্যাথলিক, ইহুদী এবং অন্যান্য ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বিচারে নীপিড়ন করা এবং বিজ্ঞান ও যুক্তির সাথে সার্বক্ষনিক যুদ্ধ করা।
সময় এবং কাল ভেদে হয়ত এর তীব্রতা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কোন দ্বিধা ছাড়াই এই সত্যভাষন করা যেতে পারে যে, ধর্ম কখনোই, এবং পরিশেষে, তার নিজের বিস্ময়কর দা্বী এবং তথাকথিত সর্ব্বোচ্চ নৈতিক অবস্থানের পক্ষে ঐশ্বরিক সুনিশ্চয়তা নিয়েও সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। অবিশ্বাসীদের, ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জীবনে নাক গলানোর জন্য ধর্ম, অবশ্যই সবসময় তার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে। এরা যতই অন্য জীবনের অনন্ত সুখের কথা ফলাও করে প্রচার করুক না কেন, তারা এই জীবনেই সকল ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। এটাই শুধুমাত্র এর থেকে আশা করা যেতে পারে, কারন, সর্বোপরি এটা সম্পুর্ন মানব সৃষ্ট। এবং ধর্মর নিজেরই তার নিজস্ব নানা প্রচারণার উপরে কোন ভরসা রাখতে পারে না, এমন কি নানা বিশ্বাসের শান্তিপুর্ন সহাবস্থানের বিষয়টিতেও পারে না সম্মতি দিতে ।
একটি সাধারন উদহারনই দেখা যাক, যার রুপকার আধুনিক ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত চরিত্রটি; ১৯৯৬ সালে আইরিশ প্রজাতন্ত্র একটি বিশেষ প্রশ্নের উপর গনভোট এর আয়োজন করেছিল, তাদের সংবিধান কি এখনও বিবাহ বিচ্ছেদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখবে? ক্রমশ ধর্ম নিরেপক্ষতাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া দেশটির বেশীর ভাগ রাজনৈতিক দল, জনগনকে অনুরোধ করলেন এই আইনটি সংস্কার করার জন্য হ্যা ভোট দিতে। দুটো গুরুত্বপুর্ন কারনে আইরিশ নেতৃবৃন্দ এটি করতে চেয়েছিলেন: তারা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকদের নৈতিকতাকে আইনী রুপ দেবার ক্ষেত্রে ক্যাথলিক চার্চের কোন ভুমিকা থাকার ব্যপারটা আসলে সঠিক না এবং বিষয়টি অবশ্যই বিচ্ছিন্ন উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ভবিষ্যতে কোন দিন একীভুত হবার আশা করাটাও একেবারে অসম্ভব করে ফেলবে, যদি এর উত্তরের প্রোটেষ্ট্যান্ট সংখ্যালঘুরা সারাক্ষনই ক্যাথলিক যাজকদের দ্বারা শাসিত হবার সম্ভাবনার কথা ভেবে সারাক্ষনই শঙ্কিত থাকে। ক্যাথলিকদের পক্ষে এই আইন পরিবর্তনের বিপক্ষে প্রচারনা করতে বা জনগনকে ’না’ ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে চার্চ এবং ধর্মীয় কট্টরপন্হীদের সহায়তা করতে কলকাতা থেকে উড়ে আসেন মাদার তেরেসা। অন্যভাবে বিষয়টি যদি বলি, একজন আইরিশ মহিলা, যার একজন মাতাল, বউ পেটানো, ইনসেস্ট্যুয়াস বা অগম্যগামী কোন পুরুষের সাথে বিয়ে হলে, তার আর এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করার কোন অধিকার নেই এবং ক্যাথলিক মতে তার আত্মাকে বিপথগামী এবং বিপদগ্রস্থ হবে যদি সেই মহিলা নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য প্রার্থনা করে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জানান। আর যদি কেউ প্রোটেষ্ট্যান্ট হয়, তবে তারা হয় রোমের আশীর্বাদ নিতে পারে অথবা এ বিষয়ে তাদের পুরোপুরি চুপ থাকাটাই কাম্য। এমনকি না ভোটের জন্য প্রচারণাকারী ক্যাথলিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন কোন প্রস্তাবও ছিল না যে, তাদের বিশ্বাস বাকীদের উপর না চাপিয়ে ক্যাথলিকরা চাইলে তাদের চার্চের অনুগামী হতে পারে। এবং এটা হয়েছে আমাদের বৃটিশ দীপপুন্জ্ঞেই, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে। যাই হোক, গনভোটে সংবিধানের এই ধারাটি পরিবর্তিত হয়েছিল, যদিও খুবই সামান্যতম ভোটের ব্যবধানে।( এবং মাদার তেরেসা সে বছরই একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন তার বন্ধু রাজকুমারী ডায়ানা এবার সুখী হবেন, কারন তার স্পষ্টত দুর্ভাগ্যজনক বৈবাহিক সম্পর্ক অবশেষে থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু না, খু্ব একটা অবাক হবার কোন কারন নেই চার্চ এর দ্বি -মুখিতার স্বরুপ দেখে-সেটা মাদার তেরেসাই হোক না কেন-যা গরীবদের জন্য কঠোর আইন করে আর অন্যদিকে বোধগম্য কারনেই ধনীদের দেয় পশ্রয়।)
সেপ্টেম্বর ১১,২০০১ এর এক সপ্তাহ আগে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের একজন সুপরিচিত রেডিও ধর্মীয় সম্প্রচারক ডেনিস প্রেগার সাথে একটি প্যানেলে ছিলাম। তিনি আমাকে চ্যালেন্জ্ঞ করেছিলেন শ্রোতাদের সামনে, তার ভাষায় ‘সরাসরি হ্যা বা না’ উত্তর দিতে হবে এমন একটি প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য এবং আমি আনন্দের সাথে রাজী হয়েছিলাম। তিনি যেটা বলেছিলেন, সম্পুর্ন অপরিচিত একটি শহরে আমার নিজেকে কল্পনা করতে হবে, যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাকে আরো কল্পনা করতে হবে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একদল মানুষ। এখন – আমি কি, আমাকে বেশী, নাকি কম নিরাপদ ভাববো, যদি আমি জানতে পারি যে তারা এই মাত্র একটি ধর্মীয় প্রার্থনা সভা থেকে ফিরছে? পাঠকরা হয়তো বুঝতে পারবেন, এটা সে ধরনের কোন প্রশ্ন না যার কেবল হ্যা বা না উত্তর দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি এর উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছিলাম, যেন আমার জন্য এটি কোন কাল্পনিক পরিস্থিতি নয়: ”যদি শুধু ইংরেজী ’“বি’ অক্ষরেই সীমাবদ্ধ থাকি, আমি আসলে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে, বেলফাষ্ট, বৈরুত, বোম্বে, বেলগ্রেড, বেথলেহেম এবং বাগদাদে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমি দ্বীধাহীনভাবে বলতে পারি এবং কারনও ব্যাখ্যা করতে পারি, কেন এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমার তাৎক্ষনিকভোবে শঙ্কিত বোধ করা উচিৎ, যদি আমি মনে করি, সন্ধ্যা বেলায় আমার দিকে এগিয়ে আসা এই অচেনা মানুষের দলটি ফিরছে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষ করে।”
এই ছয়টি জায়গায় আমার স্বচক্ষে দেখা ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত নিষ্ঠুরতার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। বেলফাস্টে, আমি দেখেছি সমস্ত রাস্তা জুড়ে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ধ্বংশস্তুপ হয়ে আছে, খৃষ্টধর্মের বিভিন্ন সেক্ট বা সম্প্রদায়গুলোর পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের ফলে এবং আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি সেই সব মানুষেদের যাদের স্বজনদের অপহরন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে বা নির্মম অত্যাচার করেছে প্রতিদ্বন্দী ধর্মীয় গ্রুপের ডেথ স্কোয়াডদের সদস্যরা, শুধু মাত্র অন্য ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হওয়া ছাড়া প্রায়ই আর কোন অপরাধই ছিল না তাদের।একটা পুরোনো বেলফাস্টের কৌতুক আছে, একবার এক ব্যক্তিকে বেলফাস্টের কোন একটা রোড ব্লকের চেক পোষ্টে আটকানো হলে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তার ধর্ম কি? যখন সে উত্তর দেয়, সে আসলে নাস্তিক, তখন তাকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ’প্রোটেষ্ট্যান্ট নাকি ক্যাথলিক নাস্তিক?’ আমার মনে হয় এই কৌতুকটা দিয়ে বোঝা সম্ভব, কিভাবে ধর্ম নিয়ে অন্ধ মোহগ্রস্থতা স্থানীয়দের কিংবদন্তীতুল্য রসবোধেও পচন ধরেছে। যাই হোক, আমার এক বন্ধুর সাথে এই ঘটনেই ঘটেছিল, এবং অবশ্যই অভিজ্ঞতাটা সুখের ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে এই ধ্বংশযজ্ঞের অজুহাত হলে প্রতিদ্বন্দী জাতীয়তাবাদ, কিন্তু দ্বন্দরত প্রতিপক্ষ দলগুলোর রাস্তায় যে শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করে, সেগুলো প্রতিপক্ষ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অপমানজনক ( যেমন, Prods এবং Teagues)। অনেক বছর ধরে দেশটির প্রোটেষ্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চেয়েছে ক্যাথলিকদের আলাদা এবং দমন করে রাখতে। আসলেই যখন এখানে আলস্টার (Ulster) রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল, তাদের শ্লোগান ছিল, ‘একটি প্রোটেষ্ট্যান্ট সংসদ প্রোটেস্ট্যান্ট জনগনের জন্য’; ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার একটি প্রকৃতি হলো এটি খুব সুবিধাজনক ভাবে স্বউৎপাদনশীল এবং নিশ্চিৎ ভরসা রাখা যায় এর উপর যে, এটি পাল্টা পরস্পরমুখী সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেবেই। মুল ব্যাপারটায় ক্যাথলিক নেতৃত্বেরও মৌন সম্মতি আছে, যারা যাজক প্রধান স্কুল এবং পৃথকীকৃত প্রোটেষ্টান্টদের থেকে বিচ্ছিন্ন বসবাস করার এলাকাই কামনা করে; কারণ সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রন করাটা সহজ হবে। সুতরাং ঈশ্বরের নামে প্রাচীন পুর্বপুরুষের ঘৃণাগুলো নতুন প্রজন্মের স্কুলের শিশুদের মাথায় জোর করে, বলা যায় ড্রিল করে ঢোকানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে ( এমনকি ড্রিল শব্দটা আমাকে অসুস্থ করে ফেলে: কারন এ ধরনের পাওয়ার টুল বা যন্ত্র প্রায়শই ব্যবহার করা হয়ে থাকে ধর্মীয় দলগুলো বিরাগভাজন হওয়া মানুষগুলোর হাটুর মালাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য)।
১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন প্রথমবারের মত বৈরুতে আসি, তখনও শহরটাকে ’প্রাচ্যের প্যারিস’ বলে চিহ্নিত করা অসম্ভব ছিল না। তারপরও আপাতদৃষ্টিতে এই স্বর্গ বা ইডেনে নানা ধরনের সরীসৃপেরও কোন কমতি ছিল না। প্রধান যে অসুখটায় এটি আক্রান্ত ছিল তা হলো ধর্মের আধিক্যতা, বিরাজমান সবগুলো ধর্মই দেশটির গোত্রভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সংবিধানে ’কোন না কোন ভাবে জায়গা’ করে নিয়ে নিয়েছিল। আইনগতভাবে দেশটির রাষ্ট্রপতিকে হতে হবে একজন খৃষ্টধর্মীকে, সাধানত: কোন একজন ম্যারোনাইট ক্যাথলিক, সংসদের স্পীকার হবেন একজন মসুলমান এবং এভাবে আরো অনেক র্ধ্ম ভিত্তিক পদ। স্পষ্টতই এই পদ্ধতিটি কখনোই সুষ্ঠভাবে কাজ করেনি। কারন বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস, এমনকি বর্ণ ও জাতিগত পরিচয়ের বিভেদগুলোকে এটি সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছিল ( যেমন, মসুলমানদের গোত্র শিয়ারা ছিল সামাজিক শ্রেনীবিন্যাসের সবচেয়ে নীচের স্তরে এবং এছাড়া কুর্দদের ছিলনা কোন ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার)।
প্রধান যে খৃষ্টীয় দলটি ছিল, তারা আসলে ছিল একটি ক্যাথলিক মিলিশিয়ার দল, ফ্যালান্জ বা ফ্যালাঙ্কস (Phalange বা Phalanx); দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পিয়ের জেমাইয়েল বলে একজন ম্যারোনাইট লেবাননীয় ক্যাথলিক ব্যক্তি, যিনি ১৯৩৬ সালে হিটলারের আয়োজিত বার্লিন অলিম্পিক দেখে ভীষন মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার এই ধর্ম ভিত্তিক দলটি আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি পায় ১৯৮২ সালে, লেবাননে শাতিলা সাবরায় প্যালেষ্টাইনীয়দের শরনার্থী শিবিরে, ইসরায়েলী জেনারেল শ্যারন এর সরাসরি নির্দেশে ব্যপক গনহত্যা পরিচালনায প্রধান ভুমিকা রাখার মাধ্যমে। একজন ইহুদী জেনারেল যে একটি খৃ্ষ্টীয় ফ্যাসিবাদী দলের সাথে আঁতাত করবে এটাই যথেষ্ট পরিমানে ভয়াবহ কুৎসিত একটি ঘটনা, কিন্তু তারা একজোট হয়েছিল কারন তাদের শক্র ছিল একই: মসুলমানরা। লেবাননের রাজনীতিতে ইসরায়েলের হঠাৎ প্রবেশটাই ইন্ধন যুগিয়েছিল হিজবুল্লাহর সৃষ্টিতে, যদিও বেশ নম্রভাবে নামকৃত ‘আল্লাহর দল’, এটি মুলত: লেবাননের অবহেলিত শিয়াদের সংগঠিত করে ধীরে ধীরে নিয়ে আসে ইরানের ধর্মতন্ত্রের শীর্ষ নেতৃত্বর অধীনে, যারা এর তিন বছর আগে তেহরানে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। এই সুন্দর লেবাননেই সংগঠিত বা অর্গানাইজড ক্রাইম দলে সদস্যদের থেকে অপহরনের বানিজ্য দীক্ষা শেষে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরা অবশেষে ’আত্মঘাতী বোমা’ হামলার সৌন্দর্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এখনও আমি মনে করতে পারি, বোমা হামলায় প্রায় সম্পুর্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত ফরাসী দুতাবাসের সামনে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাথা পড়ে আছে রাস্তায়। মোট কথা হলো, যখনই প্রার্থনা সভা শেষ হয়, আমি রাস্তার অন্যপাশে যাওয়ার চেষ্টাই করি।
বোম্বে, এর সাগরের তীর ঘেষে চলা রাজপথে গলার হারের মত করে সাজানো আলোকসজ্জা, বিট্রিশ রাজের স্থাপত্য, সব মিলিয়ে একেও বলা হতো ’প্রাচ্যের মুক্তা’; এটি ভারতের সবচেয়ে বৈচিত্রময় বহুজাতিক শহরের একটি এবং এবং নানা স্তরের বৈচিত্রময়তাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে খুজেছিলেন লেখক সালমান রুশদী, বিশেষ করে তার The Moor’s last Sigh উপন্যাসটিতে এবং মিরা নায়ার, তার চলচ্চিত্রে। এটা সত্যি যে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে এর আগেও, যখন ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারতের স্বশাসনের স্বপক্ষে সুবিশাল ঐতিহাসিক আন্দোলন যখন বিপদগ্রস্থ করেছিল মসুলমানদের একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি এবং একজন অতি ধার্মিক হিন্দুর কংগ্রেস দলের মুল নেতৃত্ব দেবার বিষয়টি। যত পরিমান মানুষ এ্ই শহর পরিত্যাগ করেছিল বা বের করে দেয়া হয়েছিল সে সময়ের ধর্মীয় রক্তপিপাসু দাঙ্গায়, প্রায় সমপরিমান মানুষই আবার আশ্রয় পেয়েছিল এই শহরে। একধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান কিন্তু গড়ে উঠেছিল সেখানে পরবর্তীতে, সাধারনত: সমুদ্র তীরবর্তী শহরগুলোতে যেমন ঘটে থাকে এবং শহরটির উপর নানাধরনের বহিসংস্কৃতির প্রভাবের ফলে। পার্সীরা – প্রাক্তন জোরোয়াস্ট্রিয়ানরা, যাদের পার্সিয়া বা ইরানে নীপিড়ন থেকে বাচতে এখানে বসতি গড়েছিল-তারা ছিল এখানে সুপরিচিত সংখ্যালঘু, এছাড়া এই শহরে বাস করে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপুর্ন ইহুদী সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। কিন্তু বিষয়টি বাল থ্যাকারে এবং তার উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী শিব সেনাদের সন্তুষ্ট করেনি, ১৯৯০ এর দশকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বোম্বে শহর তার অনুসারীরাই শুধুমাত্র তার অনুসারীদের জন্য শাসন করবে। তিনি তার পোষা এবং ধর্মীয় জোশে উদ্বুদ্ধ গুন্ডা পান্ডাদের রাস্তায় লেলিয়ে দেন নানা অপকর্ম ঘটাতে এবং যে তার সেই শক্তি আছে, সেটা সবাইকে দেখাতে, তিনি নির্দেশ দেন এই শহরের নাম বদলিয়ে রাখতে, মুম্বাই; কিছুটা সেকারনেই আমি এই নামটি উল্লেখ করলাম শহরটির ঐতিহ্যবাহী নামের নীচে।
১৯৮০র দশক পর্যন্ত্ বেলগ্রেড ছিল প্রাক্তন ইয়োগোস্লাভিয়া ( বা দক্ষিনের স্লাভদের দেশ) র রাজধানী। যে নামের অর্থ ইঙ্গিত করেছে, এটি বহু্জাতিক এবং বহুবিশ্বাসে বিশ্বাসীদের একটি দেশের রাজধানী। আমাকে অবশ্য একজন ধর্মনিরপেক্ষমনা ক্রোয়াট বুদ্ধিজীবি একবার হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, যে বেলফাস্টের মতই, যা একটা অস্বস্তিকর কৌতুকের আকার নিয়েছিল; যদি ’আমি বলি যে আমি একজন নীরিশ্বরবাদী এবং একজন ক্রোয়াট, তখন মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কিভাবে প্রমান করবো আমি যে সার্ব না’; এর অন্য অর্থ হচ্ছে আপনি যদি ক্রোয়াট হন তাহলে আপনাকে হতে হবে রোমান ক্যাথলিক। সার্ব হতে হলে আপনাকে হতে হবে অর্থোডক্স খৃষ্টান। ১৯৪০ এর শুরুতে, এর অর্থ হচ্ছে, একটি নাৎসী জার্মান নিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল সরকার ক্ষমতা নেয় ক্রোয়েশিয়ায়, এবং যা বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে রোমান ক্যাথলিকদের কেন্দ্র ভ্যাটিক্যানের । এই ফ্যাসিবাদী ক্রোয়াট সরকার, স্বভাবতই এই এলাকা থেকে স্থানীয় ইহুদীদের বিতাড়িত ও হত্যার মাধ্যমে নির্মুল করার পাশাপাশি, অন্য খৃষ্ট ধর্ম মতাবলম্বীদেরও জোর করে ক্যাথলিক মতাবলম্বীতে রুপান্তরিত করার একটি জঘন্য ক্যামপেইনও পরিচালনা করে। এর ফলাফলে লক্ষ লক্ষ সার্ব অর্থডক্স খৃষ্টানকে হত্যা করা হয় ( যাকে ভ্যাটিক্যান হলোকষ্ট বলা হয়ে থাকে কোন কোন ক্ষেত্রে) অথবা সমুলে উৎখাত করা হয় তাদের বাসভুমি থেকে এবং এই লক্ষ্যে এই ফ্যাসিবাদী সরকারটি ইয়াসেনোভাকস (Jasenovacs) শহরে কাছে সুবিশাল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল আন্তে পাভেলিচ ও তার উসতাশে (Ustashe) পার্টির ফ্যাসিবাদী উগ্র স্বৈরশাসন এতই ভয়াবহ রকম জঘন্য প্রকৃতির ছিল যে, এমনকি বেশ কিছু জার্মান নাৎসী অফিসার এরকম একটি সরকারে সাথে জড়িত থাকতে ইচ্ছুক না বলে প্রতিবাদও করেছিল।
যখন ১৯৯২ সালে আমি ইয়াসেনোভাকস ক্যাম্প দেখতে আসি তখন নিপীড়নের জ্যাকবুটটি অন্য পায়ে। স্লোবোদান মিলোসেভিচ এর নেতৃত্বে সার্বিয়ার সামরিক বাহিনী তখন দুইটি ক্রোয়েশিয়ান শহর ভুকোভার ও দুব্রোভনিকিএ নিষ্ঠুরভাবে বোমা মেরে ধ্বংশস্তুপে পরিনত করেছে। মুসলিম প্রধান শহর সারায়েভো তখন ঘিরে রেখেছে সার্ব বাহিনী, ২৪ ঘন্টা ধরে সেখানে বোমা হামলা চলছে। বসনিয়া হারজেগোভনিয়ায় অন্য জায়গায়, বিশেষ করে দৃনা নদীর তীর ঘেষে গনহত্যা, ধর্ষন আর লুটতরাজ চালায় সার্বরা, যে অপারেশনের নাম তারা নিজেরাই দিয়েছিল, ’জাতিগত বিশোধন’; যা আসলে, ’ধর্মীয় বিশোধন’ বললেই সঠিক হতো বেশী। মিলোসেভিচ লোকটি ছিল প্রাক্তন কমিউনিষ্ট সরকারের একজন আমলা, যে পরবর্তীকে রুপান্তরিত হয় ভিন্ন জাতি বিদ্বেষী একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং তার মসুলমান বিরোধী ক্রসেড মুলত ছিল অর্থোডক্স খৃষ্টান সার্বদের জন্য বৃহত্তর সার্বিয়া সৃষ্টির লক্ষ্যে বসনিয়াকে দখল করার একটি কৌশল মাত্র। এই ক্রসেডটি পরিচালিত হয় মুলত বেসরকারী মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে, যার নিয়ন্ত্রন ছিল তার হাতেই ( যা অবশ্যই প্রথাগতভাবে অস্বীকার করা হয়েছে); এই মিলিশিয়ার দল তৈরী হয়েছিল ধর্মোউন্মাদ উগ্র মানসিকতার মৌলবাদীদের নিয়ে, যাদের নিয়মিত আশীর্বাদ দিয়েছে অর্থডক্স খৃষ্টীয় যাজক এবং বিশপরা; এবং এদের দলগুলোকে সংখ্যায় ভারী করেছে গ্রীস ও রাশিয়া থেকে আসা, তাদের মত অর্থডক্স মতাবলম্বী সেচ্ছাসবকরা। এই খৃষ্টীয় অর্থোডক্সদের মিলিশিয়া বাহিনীর নানাবিধ কুকর্মের সাথে আরো একটি অন্যতম প্রধান কাজ ছিল, অটোমান শাসনের ( মুসলিম শাসন বিধায়) স্মারক সকল ঐতিহাসিক চিহ্নকে ধ্বংশ করা, এর একটি উল্লেখযোগ্য উদহারন হচ্ছে বানিয়া লুকায় বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক মিনারকে ডায়নামাইট দিয়ে ধ্বংশ করা। এই কাজটি তারা করেছিল পরিকল্পনা মোতাবেক যুদ্ধবিরতির সময়, কোন যুদ্ধের অংশ হিসাবে না।
অন্যদিকে আবার একই ঘটনা ঘটিয়েছিল তাদের ক্যাথলিক প্রতিপক্ষও, যদিও প্রায়ই যেটা ভুলে যাওয়া হয়। কমিউনিষ্ট শাসনামলের অবসান ঘটলে, ক্রোয়েশিয়ায় উসতাশে আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটে, এবং ক্রোয়েশিয়াও জোর করে হারজেগোভনিয়া ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা তাদের দখলে (নাৎসী সমর্থিত ক্রোয়েশিয়া) ছিল। এই বলকান যুদ্ধের সময় অন্য সীমান্ত দিয়ে বসনিয়া হারজেগোভনিয়ার আরেকটি অপুর্ব সুন্দর শহর মোস্তারকে বোমা মেরে ধ্বংশ করে ক্রোয়েশিয়ার সামরিক বাহিনী। মোস্তারের কেন্দ্রে স্টারি মোস্ত বা পুরোনো ব্রীজ, যা ছিল একটি সুপরিচিত ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এবং তুরস্কের শাসনামলের একটি নিদর্শন; ক্রোয়েশীয় মিলিশিয়ারা এটাকে বোমা মেরেছিল যতক্ষন না পর্যন্ত এটি নীচের নদীতে সম্পুর্ন ভেঙ্গে পড়ে। আসলে উগ্রপন্হী ক্রোয়াট এবং সার্ব বাহিনী পরস্পরের সাথে এক অশুভ আঁতাত করেছিল বসনিয়া-হারজেগভনিয়াকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভাগ এবং ধর্মীয় বিশোধন (মসুলমান নিধন) করার প্রক্রিয়ায়। তারা সেই সময়ে এবং এখনও বিশ্ব ব্যাপী এই অপকর্মের লজ্জা এড়াতে পারছে, কারন খবর প্রকাশের গণমাধ্যমগুলো শব্দগুলোর অতিসরলীকরণ পছন্দ করে, যেমন ক্রোয়াট, সার্ব এবং শুধুমাত্র তারা যখন মুসলিমদের নিয়ে আলোচনা করে, তখনই কেবল ধর্ম বিষয়টি উল্লেখিত হয়। কিন্তু এই তিনটি শব্দ ক্রোয়াট, সার্বে এবং মুসলিম সমতুল্য না এবং বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী, কারন এখানে শব্দগুলো দুটি জাতীয়তা এবং একটি ধর্মকে নির্দেশ করছে (এই একই ভুল অন্যরকম ভাবে ইরাকের খবর পরিবেশনের সময়ও করা হয়েছে: শিয়া, সুন্নী এবং কুর্দ এই ত্রিপাক্ষিক সংঘর্ষকে ব্যাখ্যা করতে); বসনিয়ার সারায়েভোকে যখন অবরোধ করে রাখা হয়েছিল, তখন সেখানে ছিল প্রায় ১০,০০০ সার্ব, সারায়েভো রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত বাহিনীর নের্তৃত্ব স্থানীয় একজন কম্যান্ডার ছিলেন জেনারেল ইয়োভান দিভইয়াক, যুদ্ধের সময় যে ভদ্রলোকটির সাথে হাত মেলানোর সুযোগ পেয়েছিলাম বলে আমি গর্ব করতে পারি, তিনি নিজেও একজন সার্ব। শহরের ইহুদী জনসংখ্যা, যারা সেই ১৪৯২ সাল থেকে বসতি গড়েছে এখানে, তারাও বসনিয়া সরকারের সাথেই ছিল সবসময়। বিবরণগুলো অনেক বেশী সঠিক হতো যদি যদি টেলিভিশন এবং পত্রপত্রিকা খবরটাকে এভাবে পরিবেশন করতেন: আজ অর্থডক্স খৃষ্টান বাহিনী সারায়েভোর উপর তাদের বোমা বর্ষন অব্যাহত রেখেছে বা গতকাল ক্যাথলিক মিলিশিয়ারা মোস্তারে স্টারি মোস্ট সেতুটিকে ধ্বংশ করতে সফল হয়েছে। কিন্তু এই ধর্মীয় পরিচয় সংরক্ষিত রাখা হয়েছে শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য যখন তাদের খুনী ধর্ষনকারীরা, তাদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে চিহ্নিত করার চেষ্টার কোন ক্রটি করেনি: যেমন মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের ব্যান্ডোলিয়ের ( গুলি রাখার বেল্ট) এ বড় অর্থডক্স ক্রস লাগানো থাকতো কিংবা কুমারী মাতা মেরীর ছবি সাটা থাকতো তাদের রাইফেল বাটে । এভাবেই ধর্ম সবকিছুকে বিষাক্ত করে তোলে, এমনকি আমাদের নিজেদের প্রকৃত ঘটনার পার্থক্য বোঝার ক্ষমতাটাকে।
বেথলেহেমের ক্ষেত্রে, আমার মনে হয় আমি জনাব ডেনিস প্রেগারকে কোন ভালো দিনে শুধুমাত্র ছাড় দিতে পারি। সম্ভবত আমি যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করবো কোন সন্ধ্যাবেলায় চার্চ অব ন্যাটিভিটির সামনে দাড়িয়ে থাকতে। এই বেথলেহেমেই, জেরুজালেম থেকে বেশী দুরে নয়, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, একজন অস্পৃশ্য কুমারীর সহায়তায় ঈশ্বর তার পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন।
”এভাবেই যীশু খৃষ্টের জন্ম হলো। তার মা মেরীর বিয়ে ঠিক ছিল জোসেফের সাথে, কিন্তু তারা একসাথে হবার আগে, মেরী পবিত্র আত্মার মাধ্যমে অন্তসত্ত্বা হলেন”। হ্যা, এভাবেই গ্রীক অর্ধদেবতা পার্সিউসেরও জন্ম হয়েছিল, যখন দেবতা জুপিটার কুমারী ডানাই র কাছে আসেন স্বর্ণর বৃষ্টি ধারা হিসাবে এবং তার গর্ভে জন্ম দেন একটি পুত্র সন্তানের । বুদ্ধেরও জন্ম হয়েছিল তার মায়ের শরীরের পাশের একটি খোলা জায়গা দিয়ে। জোড়াসাপে ঘেরা ক্যাটলিকাস, পালকের একটা বল, আকাশ থেকে নিয়ে নিজের বুকে লুকিয়ে রেখেছিল এবং অ্যাজটেক দেবতা হুইটজিলোপোচ্টলীর এভাবে জন্ম হয়েছিল তার গর্ভে। নিহত আজদেশট্রিশ এর রক্তে প্রতিপালিতেএকটি ডালিম গাছ খেকে কুমারী নানা একটা ডালিম পাড়েন এবং তার বুকের উপর এটি রাখেন এবং দেবতা অ্যাটিসের জন্ম হয় সেখানে। এক মঙ্গোল রাজার কুমারী কন্যা একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেন তিনি স্বর্গীয় আলোয় অবগাহন করছেন, যা তাকে গর্ভবতী করে ফেলে এবং গেন্জিস খানের জন্ম দেন। কুমারী দেবকার গর্ভে জন্ম নেন কৃষ্ণ। হোরাস এর জন্ম হয়েছিল কুমারী আইসিসের গর্ভে, মার্কারীকে জন্ম দিয়েছিলেন কুমারী মায়া। কুমারী রিয়া সিলভিয়া জন্ম দিয়েছিল রোমুলাসের। কোন বিশেষ কারনে বহু ধর্মীয় শক্তিই মনে করে যে নারীর সন্তার প্রসবের পথ একমুখী চলাচলের বা ওয়ান ওয়ে রাস্তার মত; এবং এমনকি কোরানও কুমারী মেরীকে দেখেছে বিশেষ সন্মানের সাথে। কিন্তু যাই হোক বিষয়টা পরবর্তীতে ধর্মযুদ্ধগুলোর উপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি, পোপের সেনাবাহিনী যখন বেথলেহেম এবং জেরুজালেম মুসলিমদের থেকে দখল করার যাত্রা শুরু করে, সারা পথে তারা বহু ইহুদী বসতিও ধ্বংশ করেছে, ভিন্নমতাবলম্বী খৃষ্টীয় বাইজানটিয়ামে লুট তরাজ করেছে এবং জেরুজালেমের সরু রাস্তায় তারা এমনই গনহত্যা চালিয়েছিল যে, উন্মত্ত, বিকৃত আনন্দে বিভোর এসব ঘটনার লিপিবদ্ধকারীদের বিবরন অনুযায়ী,সেখানে গনহত্যায় নিহত মানুষের রক্ত নাকি ধর্মযোদ্ধাদের ঘোড়ার লাগাম অবধি উঠেছিল।
এরকম কিছু ধর্মীয় ঘৃনা, জাতিগত বিদ্বেষ, গোড়ামী আর রক্তপিপাসার ঝড় হয়ত এখন অতিক্রান্ত হয়েছে, তারপরও এই এলাকায় এররকম আরো নতুন ঝড় সবসময়ই প্রত্যাসন্ন কিন্তু সে অবধি যে কেউই এই ’ম্যান্জার স্কোয়ার’ এ আপাতত নিজেকে আপেক্ষিকভাবে তেমন নিগৃহীত নাও ভাবতে পারেন। এই ম্যান্জার স্কোয়ারটি হচ্ছে শহরটির কেন্দ্র, এর নাম যেমন ইঙ্গিত করছে, একটি টুরিষ্ট ধরার এমন একটা চুড়ান্তভাবে রুচিহীন ফাদ, যে ল্যুর্ডকেও ( ফরাসী একটি গ্রাম, যেখানে কুমারী মার অশরীরি আবির্ভাব দেখেছেন বলে স্থানীয়রা দাবী করেছিলেন) লজ্জায় ফেলে দেবে। আমি প্রথম যখন এই করুণ শহরটি এসেছিলাম, এটা নামে মাত্র মুলত খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী প্যালেস্টাইনদের নিয়ন্ত্রিত একটি পৌরসভার অধীনে ছিল, যা মুলত সম্পর্কযুক্ত ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের সাথে যারা পরিচিত ছিল ফ্রেইজ পরিবার নামে। এর পরে শহরটিকে আবার যখন দেখি, তার আগ পর্যন্ত এটি ছিল মুলত ইসরায়েলী সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর কারফিউর অধীনে-যে কর্তৃপক্ষের নিজেদের এই ওয়েষ্ট ব্যাঙ্কে উপস্থিতিটাই আবার কোন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ভবিষ্যতবানীর সাথে কিন্তু সম্পর্কহীন নয়। যদিও পরবর্তীতে এই সময় তাদের উপস্থিতি অন্য একটি ধর্মীয় গ্রুপের মানুষের কাছে অন্য আরেক ঈশ্বরের করা প্রতিজ্ঞার সাথে সম্পর্কিত ছিল। হামাসের শক্তিশালী নেতৃত্ব, যারা দাবী করে পুরো প্যালেষ্টাইনটা একটি ইসলামী ওয়াকফ সম্পত্তি বা ইসলামের জন্য করা পবিত্র কোন দান, ধীরে ধীরে বেথলেহেমে এর খৃষ্ঠান প্যালেস্টাইনীদের ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দেয়। তাদের নেতা মাহমুদ আল জহর, ঘোষনা দেন যে ইসলামিক স্টেট অব প্যালেস্টাইন এর সকল অধিবাসীরা মুসলিম আইন মেনে চলবে, তেমনটাই আশা করা হচ্ছে। বেথলেহেমে, এখন প্রস্তাব করা হয়েছে অমুসলিমদের উপর আল-জেজিয়া কর আরোপ করা হবে. সেই ঐতিহাসিক কর যা পুরোনো অটোমান সাম্রাজ্য ধিম্মি বা অবিশ্বাসী ( শরীয়া আইন অনুযায়ী, ইহুদী, খৃষ্ঠান ইত্যাদি, ট্যাক্সের বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র যাদের নাগরিক অধিকার ও সুরক্ষা প্রদান করার দাবী করে); এই পৌরসভার মহিলা কর্মচারীদের নিষিদ্ধ করা হয় পুরুষ দর্শনার্থীদের সাথে করমর্দন করে শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা পরিত্যাগ করতে। গাজা শহরে ইউসরা আল আজামী নামের এক তরুনীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, একটা গাড়ীতে তার হবু স্বামীর সাথে বসে থাকার কারনে। তার তরুন বর অবশ্য জানে বেচে যায় ভয়ঙ্কর নির্যাতন সহ্য করার পর। হামাসের নেতারা তাদের তথাকথিত ‘ভাইস এবং ভার্চু‘ স্কোয়াডের এই অহেতুক হত্যা আর নির্যাতনের স্বপক্ষে সাফাই গেয়েছে এই বলে যে তারা ‘সন্দেহজনক অনৈতিক ব্যবহার‘ এ জড়িত ছিল। একদা ধর্মনিরেপক্ষ প্যালেস্টাইনে, ভয়াবহভাবে যৌন অবদমিত তরুনদের দলকে এখন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পার্ক করা গাড়ীর মধ্যে উকি মেরে দেখতে এবং তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে, যা ইচ্ছা তাই করবার জন্য।
To be Continue….
সাম্প্রতিক মন্তব্য